Thank you for trying Sticky AMP!!

হুমায়ুন ফরীদি

হুমায়ুন ফরীদি কেন অনন্য?

আজ অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন। তাঁর অভিনয়ের অনন্যতা কোথায়? কেন অন্য অভিনেতাদের চেয়ে আলাদা ছিলেন তিনি? অভিনয়ে তাঁর বড়ত্ব কোথায়? এই অভিনয়শিল্পীর জন্মদিনে প্রশ্নগুলোর সুলুক সন্ধান।

হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়জীবন স্মরণ করতে গেলে, কালজয়ী কোনো সিনেমা চোখের সামনে ভেসে ওঠে না—এটা একটা দুঃখ। অজস্র সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁকে আমরা চিনেছি টেলিভিশন নাটক দিয়ে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে, মুনা কান্নাচাপা ফোলা চোখে উকিলের সামনে বসা। সাদা শার্ট, হাতে কায়দা করে ধরা সিগারেট। হঠাৎ তীব্রভাবে হেসে উঠলেন। গম্ভীর, কখনো চাপা সংলাপে মুনাকে সান্ত্বনা দিলেন। সেই উকিল হুমায়ুন ফরীদি। আমরা হুমায়ুন ফরীদিকে চিনলাম।

টেলিভিশন নাটকের দৃশ্যে সুবর্ণা ও হুমায়ুন ফরীদি

কিন্তু হুমায়ুন ফরীদি কেন অন্য অভিনেতাদের চেয়ে আলাদা ছিলেন? কেন তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য? অভিনয়ে তাঁর বড়ত্ব কোথায়? তাঁর অভিনয়ক্ষমতা বুঝতে হলে এ বিষয়গুলোর দিকে ফিরে তাকানো জরুরি।  

আমাদের আগের প্রজন্ম হুমায়ুন ফরীদির মঞ্চে অভিনয় নিয়ে অনেক কথা বলেন। মঞ্চের মাধ্যমেই তাঁর অভিনয়জীবন শুরু। কিন্তু মঞ্চে তাঁর অভিনয় দেখার সৌভাগ্য আমার যেমন হয়নি, আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই হয়নি। আমরা টেলিভিশন আর চলচ্চিত্রে অভিনয় দেখেই তাঁকে চিনেছি।

হুমায়ুন ফরীদি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন

টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করতে করতেই শুরু হয় হুমায়ুন ফরীদির সিনেমা অধ্যায়। কিন্তু আফসোস, বড় পর্দায় এই অভিনয়শিল্পীর বড়ত্বকে আমরা ধারণ করতে পারিনি। সিনেমার পাশাপাশি তখন টেলিভিশনেও তিনি অভিনয় করছেন। এখানে নিবিড়ভাবে দেখলে একটা জিনিস বোঝা যাবে, সিনেমার ফরীদি আর টেলিভিশনের ফরীদি আসলে এক মানুষ নন। মানে, তাঁর অভিনয় স্টাইল, তাঁর ব্যক্তিত্ব আলাদা হয়ে যেত এই দুই মাধ্যমে অভিনয়ের সময়ে। একই মানুষ দুই পর্দায় সম্পূর্ণ দুই রকম হয়ে যাচ্ছেন, এটা তাঁর একটা ম্যাজিকই ছিল বটে। বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে খুব কমজনের ভেতরেই বিষয়টি আছে, অর্থাৎ দুই পর্দায় দুই রকমভাবে নিজেকে ভেঙে ফেলার বিষয়টা। এই ভাঙা-গড়াটা হুমায়ুন ফরীদি করতেন, মানে করতে পারতেন। এটা ছিল তাঁর অভিনয়ের অনন্য একটা দিক।

সিনেমার ফরীদি আর টেলিভিশনের ফরীদি আসলে এক মানুষ নন। মানে তাঁর অভিনয় স্টাইল, তাঁর ব্যক্তিত্ব আলাদা হয়ে যেত এই দুই মাধ্যমে অভিনয়ের সময়ে। একই মানুষ দুই পর্দায় সম্পূর্ণ দুই রকম হয়ে যাচ্ছেন—এটা তাঁর একটা ম্যাজিকই ছিল বটে।

হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়ের যে একটা সাবলীলতা এবং একটা যে সহজাত ব্যাপার, সেটা দেখা যায় সাদা-কালো পর্দায় ১৯৮৫ সালে নির্মিত শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত ‘দহন’ সিনেমায়। সেখানে যে ফরীদিকে আমরা দেখতে পাই, তা যেন সময় থেকে এক যুগ আগানো একজন অভিনেতা। তখন সিনেমা (অনেকাংশে এখনো) মানেই উচ্চকিত অঙ্গভঙ্গি, অতি অভিনয়ে ভরপুর মেলোড্রামা। সেই সময়ে ফরীদির যে ‘ন্যাচারালিস্টিক’ অভিনয়, তা এখনো আমাদের বিস্মিত করে। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমার কথা মনে পড়ছে। ওই সিনেমাতে দেখা যায়, উত্তম কুমারের ভেতরে দহন হচ্ছে। তাঁর সিনিয়র অভিনেতা তাঁকে যে ভঙ্গিতে অভিনয় করতে বলছেন, সেটা সেকেলে। সেই অভিনয় চলবে না। চলতে পারে না। হুমায়ুন ফরীদিও তাঁর সময় থেকে এগিয়ে গিয়েছিলেন অনেকখানি—কী অভিনয়ে, কী ব্যক্তিত্বে।

‘সংশপ্তক’ নাটকে হুমায়ুন ফরীদি ও খলিল

কিন্তু তারপর! তারপর ধীরে ধীরে যেন ফরীদি নিজেকে অপচয় করেছেন; অথবা উল্টো করে বলা যায়, আমরা তাঁকে অপচয় করেছি।  

এই অভিনেতাকে নিয়ে অনেক গল্প আমরা শুনি। শুনতে শুনতে সেগুলো এখন প্রায় মিথের পর্যায়ে চলে গেছে। একজন অভিনেতার কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পেছনে অভিনয়গুণের পাশাপাশি প্রবল ম্যাজিকেল ব্যক্তিত্ব থাকা প্রয়োজন। হুমায়ুন ফরীদি—আমাদের কাছে যিনি ছিলেন ফরীদি ভাই—তাঁর মধ্যে ওই ম্যাজিক ছিল। তিনি সেই বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন তাঁর সহজাত স্টাইলেই।

একজন সিনিয়র পরিচালকের কাছে শোনা গল্প। একটা টিভি সিরিয়ালের শুটিং লোকেশন অনেক দূরে মানিকগঞ্জ বা ধামরাইতে। ফরীদি ভাই সকালে শুটিংয়ে গেলেন। চা খেতে খেতে মেকআপ নিলেন। টানা সিগারেট খাচ্ছেন, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, বসে থেকে হঠাৎ পরিচালককে বললেন, ‘আজ শুটিং করার মুড পাচ্ছি না। আজ চলে যাই।’ তিনি চলে এলেন। আসলে তিনি ছিলেন এমনই।

সিনেমার দৃশ্যে সোহেল রানা, হুমায়ুন ফরীদি ও রুবেল

হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের পঞ্চম আবর্তনের ছাত্র। আর আমি ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩তম আবর্তনের ছাত্র। সেই সূত্রে তিনি আমার ক্যাম্পাসের বড় ভাই। তাঁর ক্যাম্পাসজীবনের অনেক গল্পও আমরা শুনেছি। সেসব গল্পের মধ্যেও রয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয়। নিজের মুদ্রাদোষে অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব—দুই ক্ষেত্রেই তিনি আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।

একজন অভিনেতাকে আসলে ম্যাজিশিয়ান হতে হয়। ফরীদি ভাইয়ের কণ্ঠে একটা চৌম্বক শক্তি ছিল; বা বলা যায় আবেশ, যা দিয়ে তিনি মানুষকে আকর্ষণ করতেন। আপনার আবেশ এখনো আছে ফরীদি ভাই।

ইউটিউবে এখনো মাঝেমধ্যেই শুনি আপনার সাবলীল সেই আবৃত্তি, ‘নবীন কিশোর তোমাকে দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ...’। কী গম্ভীর, কী নিঃসঙ্গ, কী একার সন্ন্যাসের মতো সেই কণ্ঠস্বর!

আপনি তো নবীন কিশোরই ছিলেন, ফরীদি ভাই!