Thank you for trying Sticky AMP!!

টাইটান ও ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া ট্রলারের ছবি অবলম্বনে কোলাজ

আমরা কি তাহলে ধনীদের নিয়ে আলাপ করতে ভালোবাসি

জনপরিসরে সাধারণত আমরা কীভাবে আলাপ করি? কোনো আলাপ উত্থাপনের ক্ষেত্রে সাধারণত আমাদের অবচেতনে কোন বিষয়টি কাজ করে?

২২ ফুট লম্বা একটি ডুবোজাহাজ। টাইটেনিয়ান আর কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি এক কাঠামো। পাঁচজন আরোহী নিয়ে তা নিয়ে যেতে পারে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে। ১০ ঘণ্টার যাত্রায় মাত্র ২০ মিনিট টাইটানিক দর্শনের সুযোগ পান আরোহীরা। এই পরিবহনের আসন মাত্র পাঁচটি। আর প্রতিটি আসনের মূল্য আড়াই লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ। ডলারের বাজারের হিসাবে এ অঙ্ক অবশ্য কিছুটা ওঠানামা করতে পারে।

টাইটান নামের এই ডুবোজাহাজ ১৮ জুন আটলান্টিকে অবরোহণের পৌনে দুই ঘণ্টার মাথায় নিখোঁজ হয়। এরপর সাড়া পড়ে যায় গোটা বিশ্বে। ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রজুড়ে শুরু হয় বহুজাতিক অভিযান। মার্কিন কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণে বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন তথ্য। চার দিনের ব্যাপক অভিযানের প্রতি মুহূর্তের আপডেট জানতে উৎসুক ছিলেন বিশ্ববাসী।

অত্যাধুনিক রোবোটিক যন্ত্র প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফুট পানির তলায় গিয়ে অবশেষে খুঁজে পায় টাইটানের ধ্বংসাবশেষ। পাঁচ আরোহীর পরিবার, তাঁরা কী করতেন, তাঁদের সতীর্থরা কী ভাবছেন, তাঁরা জীবনে কী করতে চেয়েছিলেন—এসব নিয়ে বিস্তর আলাপ এখনো চলমান—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে গণমাধ্যমের সর্বত্র। টাইটানের সর্ব কনিষ্ঠ আরোহী ১৯ বছর বয়সী সুলেমান দাউদের রুবিকস কিউব প্রীতি নিয়ে বিরাট প্রতিবেদন করেছে বিবিসি। বাবা দিবসে কেবল বাবাকে খুশি করতেই তিনি আড়াই লাখ ডলার খরচা করে এই অভিযানে যান। তাঁর টাইটানিকপ্রেমী বাবা টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ স্বচক্ষে দেখতে দারুণ আগ্রহী ছিলেন।

টাইটান নিখোঁজ হওয়ার ৪ দিন আগে ১৪ জুন বিশ্বে আরেকটি নিমজ্জনের ঘটনাও ঘটেছিল।

ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায় একটি মাছ ধরা ট্রলার। পাঁচ দিন ধরে সাড়ে সাত শ আরোহী নিয়ে সাগরে ভাসছিল ট্রলারটি। এরা সবাই পাকিস্তানি, সিরীয়, মিসরীয় আর ফিলিস্তিনি শরণার্থী। লিবিয়ার তবরুক থেকে ট্রলারটি রওনা হয়েছিল ইতালির উদ্দেশে। যত দিনে তাঁরা গ্রিস উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছান, ততক্ষণে তাঁদের পানি ফুরিয়ে আসছিল। খাবার ও পানির জন্য নিজেদের মধ্যে লড়ছিলেন তাঁরা।

একপর্যায়ে বিভিন্ন বোতলে জমা করে রাখা মূত্র পান করা শুরু করেছিলেন। মরতে শুরু করেছিল মানুষ। বাঁচার জন্য যেকোনোভাবে তাঁরা মাটির দেখা পেতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাত্র ১০৫ জনের সেই সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁদের ট্রলারটি চিহ্নিত করার পরও প্রায় ৬৫০ মানুষকে বাঁচানো যায়নি। একপর্যায়ে ট্রলারটি ভেঙে তলিয়ে যায়।

তবে এই মানুষগুলোকে নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে তেমন হইচই চোখে পড়েনি। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত বা পালিয়ে আসা এই শরণার্থীরা এতটা বিপৎসংকুল পথে কেন যাত্রা করেছিলেন, তা–ও কেউ জানতে চায়নি। কেন গ্রিস তাঁদের আশ্রয় দিল না, কেন তিনটি জাহাজ তাঁদের বাঁচাতে পারল না, সেই জবাবদিহিও কাউকে করতে হয়নি খুব একটা।

উচ্চতর আর্থসামাজিক অবস্থান অর্জন আমাদের সবারই লক্ষ্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদের ক্রমাগত আরও উপার্জনের দিকে ঠেলছে। প্রতিনিয়তই আমাদের সামনে ছুড়ে দিচ্ছে ‘টার্গেট’ নামের প্রলোভনের রংদার মোড়ক। বেশি আয় মানে বেশি ব্যয়। আয়েশি জীবনযাত্রা। ফলে সেই পথ খুঁজতেই খুঁজতেই হয়তো আমরা কেবলই বিত্তবানদের দিকে তাকাই।

গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টাইটান ডুবে যাওয়া নিয়ে যতটা আলাপ হয়েছে, তার তুলনায় ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবি নিয়ে তেমনভাবে উচ্চবাচ্য হয়নি। কথা হলো, সমাজে ও জনপরিসরে একটি আলাপ বা বয়ান কীভাবে তৈরি হয়? কারা ওই আলাপ তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে? কেন ভূমধ্যসাগরের এই ট্রলারডুবি নিয়ে ততটা আলাপ হলো না? তাহলে কি আমরা ধনীদের নিয়ে আলাপ করতে ভালোবাসি? তাঁদের খবরই জানতে চাই?—এসব প্রশ্নের তলা ঘেঁটে দেখলেই উত্তরগুলো পাওয়া যাবে।

উচ্চতর আর্থসামাজিক অবস্থান অর্জন আমাদের সবারই লক্ষ্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদের ক্রমাগত আরও উপার্জনের দিকে ঠেলছে। প্রতিনিয়তই আমাদের সামনে ছুড়ে দিচ্ছে ‘টার্গেট’ নামের প্রলভনের রংদার মোড়ক। বেশি আয় মানে বেশি ব্যয়। আয়েশি জীবনযাত্রা। ফলে সেই পথ খুঁজতেই খুঁজতেই হয়তো আমরা কেবলই বিত্তবানদের দিকে তাকাই। তাঁদের ফেলে যাওয়া রুটির টুকরা অনুসরণ করে যদি পৌঁছে যেতে পারি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে! ঠিক যেমন করে আমরা মানুষের সফল হওয়ার সংবাদে এখন বেশি ক্লিক করি, কায়দাটা অনেকটা তেমনই। এগুলো অবচেতনেই আমাদের মধ্যে কাজ করে। বলা দরকার, নানান প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দিন দিন এই কায়দাগুলো শিখিয়েছে আমাদের। শুধু তা–ই নয়, আমাদের সাম্প্রতিক জনসংস্কৃতি—সে জীবনযাপন, গণমাধ্যম, শিল্পসাহিত্য–সংস্কৃতি—কমবেশি সবখানেই আছে এই একই কায়দার প্রতিফলন।

Also Read: ফেসবুক লাইভ আমাদের কী শেখায়

আড়াই কোটি টাকার বেশি খরচ করে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া টাইটান আরোহী আর মাছ ধরার জাহাজে গাদাগাদি করে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করা আরোহী—দুজনের মধ্যে ফারাকটা কেবল বিত্তের। আর এই বিত্তের জোরেই টাইটানের পাঁচ আরোহী মৃত্যুর পরও প্রচারের আলো ধরে ফেলেন। বিশ্ববাসীর মগজে গেঁথে থাকে তাঁদের নাম, বংশপরিচয়; এমনকি তাঁদের শখও। অথচ অমানবিক জীবন থেকে একটু ভালো জীবন অথবা শুধুই বেঁচে থাকার আশায় দেশ ছেড়ে আসা শত শত মানুষ বেনামি হয়ে থাকেন মৃত্যুতেও! আর যাঁরা বেঁচে থাকেন, তাঁরাও নাম বলতে ভয় পান। কারণ, এতে যদি তাঁদের শরণার্থীশিবিরের আশ্রয়টুকুও কেড়ে নেওয়া হয়!

তাই কাদম্বরী মরিয়াও প্রমাণ করতে পারে না, সে কখনো বেঁচে ছিল।

Also Read: ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’ যে বয়ান হাজির করে