আদমজী পাটকল হতে দেবেন না
অনুজ প্রতিম জনপ্রিয় শিক্ষক ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বছর কয়েক আগে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলেন এই প্রশ্ন রেখে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি আদমজী পাটকলের ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে? তখন চারদলীয় জোট সরকারের আমল। বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে, সেই অজুহাতে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে সরকার বিশ্বের বৃহত্তম পাটকলটি রাতারাতি বন্ধ করে দিল। পাটকলটি নিয়ে এই দেশের মানুষের একটি গর্ব ছিল। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে আদমজী পাটকল বন্ধ করল আর একই বিশ্বব্যাংক ভারতকে একই সময় তিনটি পাটকল প্রতিষ্ঠা করার জন্য অর্থায়ন করল। সেটি অন্য প্রসঙ্গ।
যখন জাফর ইকবাল কলামটি লেখেন তখন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের হানাহানিতে একজন নিরীহ ছাত্রের মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ছাত্র সংঘর্ষের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়। সংস্কৃতিটা সেই আইয়ুব-মোনায়েম খানের জামানা থেকে চলে আসছে। বর্তমানে তা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়েছে। সম্প্রতি একই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো। কিছু ফি বৃদ্ধির জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ হলো। এমন ঘটনা কিন্তু নতুন কিছু নয়। একবার আমার আগের কর্মক্ষেত্রে ৪০ মাইলের বাসভাড়া পাঁচ টাকা থেকে সাত টাকায় বৃদ্ধি করায় ছাত্রীরা আমাকে ১৭ ঘণ্টা অবরোধ করে রেখেছিল।
২০১০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু এককালীন ফি বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো আন্দোলন গড়ে তুললে সেই আন্দোলন অনেকটা শান্তিপূর্ণ থাকলেও অচিরেই তাদের অজান্তে আন্দোলন ক্যাম্পাস দখলধারী ইসলামী ছাত্রশিবির ছিনতাই করে নিয়ে যায় এবং ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাঙচুর করে প্রায় কোটি টাকার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ ধ্বংস করে। অথচ এই সম্পদগুলো জনগণের অর্থে শিক্ষার্থীদের জন্য কেনা হয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ঠিক অনুরূপ আন্দোলন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম খবর দিচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ফি বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন, সেগুলো অধিকাংশই এককালীন দেয়। যেমন নন-কলেজিয়েট ফি। ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে তা এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ফি শুধু তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য, যাঁদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিতি থাকেন না। যে ছাত্রটি এই ন্যূনতম সংখ্যক ক্লাসে উপস্থিত থাকেন না, তিনি যদি পরীক্ষা দিতে চান তাহলে তাঁকে জরিমানা তো দিতেই হবে। একজন ছাত্র সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে দুবার সনদপত্র উত্তোলন করেন। তাঁকে ২০০ টাকার পরিবর্তে ৫০০ টাকা দিতে হবে। এতেই আপত্তি। যাঁরা প্রধানত, এই আপত্তিটি তোলেন তাঁরা সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত এবং মনে করেন শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করা চলবে না এবং শিক্ষা সুযোগ নয়, এটি তাঁদের অধিকার। সমাজতন্ত্রের আদি জন্মস্থান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে কখনো উচ্চশিক্ষা সবার অধিকার ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষা সবার অধিকার হিসেবে চিহ্নিত ছিল। উচ্চশিক্ষায় কারা যাবে তা রাষ্ট্র ঠিক করত। মধ্য ষাটের দশকে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় সে দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয় সাত বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বিনা মূল্যে উচ্চশিক্ষা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তুকি নেই বললেই চলে। সেসব দেশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় পুরোটাই ভর্তুকির ওপর চলে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত বিপুল পরিমাণের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকে। তার ওপর আছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখা করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের সহজ শর্তে ঋণ।
ষাটের দশকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসে ১২ টাকা বেতন দিতাম। এখন তা বৃদ্ধি হয়ে ৩০ টাকা হয়েছে। হলে থাকলে বর্তমানে একজন ছাত্রকে সর্বসাকল্যে বছরে চার হাজার ৩০০ টাকার মতো বেতন ও অন্যান্য ফি দিতে হয়। মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব মতে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের পেছনে রাষ্ট্রের তথা জনগণের দেয় গড়ে ভর্তুকি বছরে পৌনঃপুনিক খাতে আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভর্তুকির পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি। যাঁরা এসব আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাঁদের অনেকেরই পকেটে থাকে কয়েক হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন আর তার পেছনে মাসে খরচ হয় আরও কয়েক শ টাকা। আবার এর ভিন্ন চিত্রও আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী আসেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। এঁরা হলে হয় সিট পান না অথবা সিট পেতে হলে বড় ভাইদের মাসোহারা দিতে হয়, না হয় মেসে থাকতে হয়, পড়ার খরচ চালানোর জন্য টিউশনি করতে হয়। কিন্তু যাঁদের পকেটে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মোবাইল ফোন, তাঁদেরও এই শেষে উল্লেখিত শিক্ষার্থীদের মতো একই পরিমাণের বেতন ও অন্যান্য ফি দিতে হয়। এখন কেউ যদি বলেন এই সমস্যা দূর করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয় বেতন ও ফির মধ্যে বিভিন্ন স্তর থাকা বাঞ্ছনীয়, যেমনটি অন্য দেশে আছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিশ্চিতভাবে যুদ্ধাবস্থা শুরু হয়ে যাবে। শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রস্তাব করছি মনে করে আমাকে অনেকে শাপান্ত করবেন। আমি নিশ্চয়ই তা করছি না। আমি চাই, প্রত্যেক যোগ্যতাসম্পন্ন ও মেধাবী ছাত্র যেন বাস্তবসম্মত উচ্চশিক্ষা থেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত না হন।
ইদানীং কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিভাগে সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু হয়েছে। এটি একটি মহলের কাছে কোনো বোধগম্য কারণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য না হলেও বলতে হয় তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমাদের সমাজের একটি বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী আছে, যাদের হয়তো ডিগ্রি পর্যায় পর্যন্ত পড়ালেখা করে চাকরিতে ঢুকতে হয়। তাদের জন্য এই সন্ধ্যাকালীন কোর্সগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার একটি বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। একসময় আমাদের দেশেও বড়দের জন্য সন্ধ্যাকালীন স্কুলের ব্যবস্থা ছিল। নিঃসন্দেহে এটিও একটি ভালো ব্যবস্থা ছিল, যা এখন আর দেখা যায় না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটাই হচ্ছে তা সারা বছর দিনে ২৪ ঘণ্টা জ্ঞানচর্চার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সেখানে কোর্সটা সন্ধ্যাকালীন না দিনের বেলায়, তা বিবেচ্য হওয়ার বদলে বিবেচ্য হওয়া উচিত দুই বেলার পড়ালেখার মধ্যে কোনো তারতম্য হচ্ছে কি না। কোনো একজন শিক্ষক যদি দিনের বেলায় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে বেশি আগ্রহী থাকেন, তাহলে তাঁকে অবশ্যই তা থেকে নিবৃত্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে। তেমন আইন না থাকলে সে রকম আইন করতে হবে। আর একজন শিক্ষক সপ্তাহে কয়টা ক্লাস নিতে পারবেন তা নির্ধারিত আছে। প্রয়োজনে তা বলবৎ করতে হবে। তবে তাঁকে দিনের বেলায় ক্লাস নেওয়াটাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনো কোনো বিদগ্ধ শিক্ষাবিদকে বলতে শুনেছি, সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়ালে দিনের বেলার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দেরি হয়। কথাটি একেবারেই অমূলক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ অথবা আইবিএতে সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু আছে, আবার তাদের পরীক্ষার ফলাফল দিতে কখনো দেরি হয় বলে শোনা যায় না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগের ৬০ জন পরীক্ষার্থীর ফলাফল দিতে দুই বছর সময়ক্ষেপণ করলে পরীক্ষার্থীরা কেক কেটে তা উদ্যাপন করেছিলেন। এর কারণ ছিল পরীক্ষা কমিটির সভাপতি চট্টগ্রামে থাকার চেয়ে ঢাকায় থাকা বেশি পছন্দ করেন। কারণ, তিনি মনে করেন, ঢাকায় থাকলে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সুযোগটা বেশি হয়। তবে বেশির ভাগ বিভাগে ফলাফল সময়মতোই প্রকাশিত হয়। সুতরাং সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আর একজন পণ্ডিত বললেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পেছনে অন্য আর একটি কারণ হচ্ছে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের পড়ালেখা দ্রুত শেষ হবে। কারণ, এখানে বিনা কারণে পড়ালেখার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। ফলাফল তাড়াতাড়ি প্রকাশিত হবে এবং তাঁরা দিনের বেলায় পড়ুয়াদের তুলনায় চাকরির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন। এটি একটি হাস্যকর যুক্তি। কারণ, দিনের বেলায় পড়ালেখায় কেন ব্যাঘাত ঘটবে? ব্যাঘাত কারা ঘটায়? তাতে ক্ষতি কার? সেই প্রশ্নের জবাব তো আগে মিলতে হবে। যারা ব্যাঘাত ঘটায়, তাদের যদি ভর্তুকি ছাড়া পড়ালেখা করতে হতো তাহলে তারা এই ব্যাঘাত ঘটানোর কথা চিন্তাই করত না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রোববারের ঘটনা যারাই ঘটাক, সত্যটা হচ্ছে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। নেতা-কর্মী যে দলেরই হোক তার হাতে এমন অস্ত্র প্রদর্শন কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো কোনো মহল থেকে এদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতে এরা আরও সাহসী হয়ে উঠবে। সরকারের নিজেদের স্বার্থে এখন উচিত হবে প্রত্যেক দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় এনে সাজা দেওয়া। ঠিক যেমনটি বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বেলায় হয়েছিল। সংসদে প্রধানমন্ত্রীও তা অঙ্গীকার করেছেন। মনে রাখা ভালো, বাংলাদেশের মতো দেশে বড় পরিসরে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার এখনো আশা-ভরসা হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে আবার তার অনেকগুলোই নানা সমস্যায় জর্জরিত। সুতরাং দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসার ও গুণগত মান রক্ষা করতে হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আদমজী পাটকলে রূপান্তরিত হতে দেওয়া চলবে না। আর মনে রাখতে হবে, একজন মেধাবী শিক্ষার্থীও যেন অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হন।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
-
সকাল ৯টার ট্রেন ছাড়েনি বেলা ২টায়ও, স্টেশনেই ঘুমিয়ে পড়েছেন ক্লান্ত মা-মেয়ে
-
বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে সাংবাদিকদের বাধা ব্যাংক লোপাটকারীদেরই উৎসাহিত করবে: নোয়াব সভাপতি
-
পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল ভারত
-
মোদির বিভাজনের রাজনীতির পেছনের কারিগর, যেভাবে উত্থান অমিত শাহর
-
ঝড়বৃষ্টি হতে পারে ৬ দিন ধরে, বলছে আবহাওয়া অফিস