Thank you for trying Sticky AMP!!

উচ্চশিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠা জরুরি

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সরকারের সমন্বয় করার জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়টি। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩৮টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে ৭৮টি। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভাল করার দায়িত্ব মঞ্জুরি কমিশনের। এর সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। উচ্চশিক্ষার যে ধারণা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর যে আস্থা রেখে মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা এখন নেই। আইনের সীমাবদ্ধতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার মঞ্জুরি কমিশনের নেই।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায়, ১৯৬৪ সালের ছাত্রদের ২২ দফায়, ১৯৬৯ সালের ছাত্রদের ১১ দফায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। সেই স্বায়ত্তশাসন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানের সুস্থ বিকাশের লক্ষ্যে। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর রাজনীতির ভূত এবং শিক্ষিত স্বার্থান্বেষীদের কালো ছায়া ভর করেছে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য কর্তৃত্বশীল অভিভাবকস্থানীয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা কমিশন খুবই জরুরি। বর্তমান সরকার উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।
গত ৬ আগস্টের প্রথম আলোর সূত্রে জানা যায়, জনপ্রশাসন এবং অর্থ মন্ত্রণালয় চায় না তাদের কর্তৃত্ব হ্রাস পায় এমন উচ্চশিক্ষা কমিশন গড়ে উঠুক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের ভাষ্য অনুযায়ী উল্লিখিত মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করলে উচ্চশিক্ষাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা সম্ভব হবে না। আইনের খসড়ায় প্রায় ৩০টি উপধারায় কার্যপরিধি নির্ধারিত হয়েছে। সেখানে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা উল্লেখ রয়েছে। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানক্রম যেমন জানা যাবে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও তুলনা করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা নির্ণয় করা যাবে। তবে কয়েকটি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা কমিশনের ক্ষমতা থাকা অত্যন্ত জরুরি। যেমন, নিয়োগ ক্ষমতা।
সংবিধানের ১৩৭ ধারা অনুযায়ী, ‘আইনের দ্বারা বাংলাদেশের জন্য এক বা একাধিক কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠার বিধান করা যাইবে এবং একজন সভাপতিকে ও আইনের দ্বারা যেরূপ নির্ধারিত হইবে, সেইরূপ অন্যান্য সদস্যকে লইয়া প্রত্যেক কমিশন গঠিত হইবে।’ বর্তমানে বাংলাদেশ কর্মকমিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের জন্য আলাদা কর্মকমিশন গঠন করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে পদোন্নতি, পদায়নসহ অনেক দায়িত্ব এই কর্মকমিশনের থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদার ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা কমিশন যাতে এই কর্মকমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করার ক্ষমতা লাভ করতে পারে, তা আইনে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। অথবা উচ্চশিক্ষা কমিশনে নিয়োগ সেল গঠন করে নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেতে পারে। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন সময়ে কদর্য বাস্তবতার সৃষ্টি হচ্ছে। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ কিংবা অর্থ লেনদেনে নিয়োগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। শুধু নিয়োগ ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে না রাখলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০-৯০ শতাংশ সমস্যা দূর হবে। সে জন্য নতুন কর্মকমিশন করতে হবে, অথবা উচ্চশিক্ষা কমিশনে ন্যস্ত করতে হবে নিয়োগসংক্রান্ত সব দায়িত্ব।
যেহেতু আইনের খসড়ায় উচ্চশিক্ষা কমিশনের একটি নিজস্ব সচিবালয়ের কথা উল্লেখ আছে, তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবালয়ের মাধ্যম বাদ দিয়ে উচ্চশিক্ষা কমিশন সচিবালয়কে সেই দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন, যার দ্বারা কমিশন সরাসরি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। ‘উচ্চশিক্ষা কমিশনে বর্তমানে বাধা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ’ (৬ আগস্ট, প্রথম আলো)।
উচ্চশিক্ষা কমিশন আইনের খসড়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ-পদোন্নতি-পদোন্নয়নবিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব বিধি অনুযায়ী সেই নীতিমালা প্রয়োগ করবে। শুধু এতটুকু না করে এর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব কমিশনের গ্রহণ করার ক্ষমতা আইনে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন ছিল। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম পদোন্নতি নীতিমালা। এসব নীতিমালার কারণে পদায়ন, পদোন্নতিকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক প্রশাসনের তল্পিবাহক হওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তাঁরাই উপাচার্যের দুর্নীতির সেফ গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের পদ্ধতি সংশোধন করে ডেমোনেস্ট্রেশন ক্লাস বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
উচ্চশিক্ষা কমিশনের প্রত্যক্ষ তদারকিতে বাংলাদেশে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্র থেকে শুরু করে উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ সব কাজ করবে এবং সনদ প্রদান করবে মূল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রেষণে শিক্ষকদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষমতা উচ্চশিক্ষা কমিশনের থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের স্বল্পতা থাকে। সে ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা কমিশন যোগ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক সেমিস্টারের জন্য প্রেষণে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে পারবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণে উচ্চশিক্ষা কমিশনকে যথাযথ ক্ষমতা দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই বললেই চলে। উচ্চশিক্ষা কমিশন করে তার ক্ষমতা বাড়িয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ক্ষমতা কমানো প্রয়োজন।
সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি অভিন্ন আইনের আওতায় আনার জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংসদে প্রস্তাব পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা থাকা জরুরি। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের নির্দেশনা নেই, সেগুলোতে উপাচার্য নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানোর ক্ষমতা উচ্চশিক্ষা কমিশনের থাকতে হবে। অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা কমিশন ছাড়া উচ্চশিক্ষার প্রসার বাংলাদেশে প্রায় অসম্ভব। এ জন্যই উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন পাস হওয়া জরুরি।
লেখকেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা।