Thank you for trying Sticky AMP!!

এবারের নির্বাচনের মূলমন্ত্র কী?

বাংলাদেশের দরজায় নির্বাচন কড়া নাড়ছে। সব গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন বড় ঘটনা। কোনো কোনো নির্বাচন ঐতিহাসিক ঘটনা। সেসব নির্বাচন জাতির জীবনে আনে ঐতিহাসিক পরিবর্তন। বাঙালি জাতির জীবনেও তেমন নির্বাচন হয়েছে কয়েকটি। প্রথমটি ১৯৩৭ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৪৬ সালে, তৃতীয়টি ১৯৫৪-তে এবং চতুর্থটি ১৯৭০-এ। স্বাধীন বাংলাদেশে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে ১৯৯১ সালে।

উপমহাদেশে প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদে ২৫০টি আসনের মধ্যে পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য ছিল ১২০টি। প্রধান রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটি-কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও কৃষক প্রজা পার্টি। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় লিগ ও প্রজা পার্টির মধ্যে। লিগ পেয়েছিল মাত্র ৪৩টি আসন। কয়েকজন স্বতন্ত্র সদস্য লীগে যোগ দিলে তার সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ৫৯। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১২৬টি আসনের।

ওই নির্বাচনে মুসলিম লিগ বাংলার মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার স্লোগান দেয়। বাংলার মানুষের কাছে তাদের ধর্মের চেয়ে অর্থনৈতিক বিষয় প্রাধান্য পায়, যদিও তারা খুবই ধর্মভীরু। কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক ভোটারদের বলেন, তিনি নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে ‘ডাল-ভাতের ব্যবস্থা’ করবেন; কৃষকদেরকে সুদখোর মহাজনদের হাত থেকে উদ্ধার করবেন। লিগের ইসলামি জিগিরের কথায় লোকে কান না দিয়ে প্রজা পার্টির কথা বিশ্বাস করল। বাংলার অধিকাংশ মুসলমান কৃষক জমিদারের অত্যাচার, শোষণ ও চক্রবৃদ্ধি ঋণের দায়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তারা বাঁচতে চাইল।

ফজলুল হক চেয়েছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন করে বাংলায় একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুরও খুবই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কংগ্রেস হাইকমান্ড হক-বসুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। হক বাধ্য হয়ে লিগের সঙ্গে কোয়ালিশন করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তাঁর সরকার অনেক ভালো কাজ করে, কিন্তু ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তাঁর প্রথম মন্ত্রিসভা কৃষককে ঋণ থেকেও মুক্তি দিতে পারেনি। তাঁর দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় ঋণ সালিসি বোর্ড আইন পাস হয়। যদিও ওই আইন বিল আকারে তৈরি করে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সরকার। আইনটির মুসাবিদা করেন আইসিএস কর্মকর্তা আজিজ আহমদ।

১৯৪৬ সালের নির্বাচন হয় পাকিস্তান ইস্যুতে। স্লোগান ওঠে, ‘হাত মে বিড়ি মুখ মে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দেয়। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা হয়েছিল, পাকিস্তানে ইসলামি ইনসাফ ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাধীনতার পর দেখা গেল, প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর এল আঘাত, লিগের ওপর থেকে বাঙালির মন উঠে গেল।

১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার নির্বাচন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের নেতা-কর্মীরা স্লোগান দিলেন, ‘লীগের পোলা বিলাত যায়/মোগের পোলা মইষ খেদায়’।

লিগের প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রীর শোচনীয় পরাজয় ঘটল, মহিষ খেদানোদের ছেলেরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেন। মুসলিম জাতীয়তাবাদের কবর রচিত হলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় হলো। কিন্তু তাদের মেয়াদ পূরণের আগেই সামরিক শাসন এল, পাকিস্তানে গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো।

১৯৭০ সালের নির্বাচন বাঙালির ভাগ্য নির্ধারণ করল। পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও শেখ মুজিবের ছয় দফার জন্য ম্যান্ডেট। নতুন স্লোগান, ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’। পাকিস্তানের কওমি সংগীতে যে বলা হয়েছিল ‘ধূসর সিন্ধু মরু সাহারা-’ বাঙালির কাছে ওসব অর্থহীন ও অবাস্তব মনে হলো। পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালি তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিল ভোটের মাধ্যমে।

বাংলার মানুষ যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চেয়েছিল, সে স্বপ্নটি অপূর্ণ থাকল। স্বাধীনতা এল, কিন্তু শোষণ-বঞ্চনার অবসান হলো না। সত্তরে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ বাস্তবে দেশটা কখনোই শ্মশান বা গোরস্থান ছিল না, সোনার বাংলাও ছিল না। ছিল সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা নদ-নদীবিধৌত বাংলা। মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচেবর্তে রইল বটে, কিন্তু যে গণতন্ত্র চেয়েছিল, তা পেল না।

অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে আরেকটি নির্বাচন হলো ১৯৯১ সালে। এবারের মূল স্লোগান দেয়ালে নয়, পোস্টারে নয়, যুবকের বুকে ও পিঠে, ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক/গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি ছিল। সেটা রক্ষা করলেন নেতারা, কিন্তু গণতন্ত্রের যে একটা অম্লমধুর স্বাদ আছে, তা থেকে বঞ্চিত হলো বাংলার মানুষ। সব সরকারের সময় বিরোধী নেতা-কর্মীদের দিয়ে ঠাসা হলো কারাগারগুলো, অন্যদিকে সরকারি দলের মোটরসাইকেল আরোহীদের অত্যাচারে গণতন্ত্র নিপাত গেল। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের উত্থান ঘটল। ধর্মান্ধতা বিকশিত হলো।

২০০৮ সালের নির্বাচনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওই নির্বাচনে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রায় দিল বাংলার মানুষ। ভোটাররা জানিয়ে দিল, তারা চায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। কিন্তু কেউ কিছু চাইলেই পাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। যারা দেওয়ার, তারা তা দিলে তো।

জাতির জীবনে আরেকটি নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচন শুধু ভোটের দিনের ব্যাপার নয়, সে এক মহা আয়োজন। যেসব দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে, সেখানে নির্বাচনের অনেক দিন আগে থেকেই দলগুলোর প্রস্তুতি চলে। প্রাথমিক প্রচারকাজে কয়েক মাস কাটে। দলগুলো ও প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে প্রতিশ্রুতি ও কর্মসূচি নিয়ে যান। তাঁরা দেশের অবস্থা জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের বক্তৃতা থেকে সাধারণ মানুষ অনেক কিছু জানে, যা শুধু মিডিয়া থেকে তারা জানতে পারে না। গণতন্ত্রের শিক্ষণীয় বা সাংস্কৃতিক দিক সেটাই।

নির্বাচনী প্রচারণা থেকে জনগণ দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা পায়, বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে জানে, জাতির আশু সমস্যা কী, তা জানতে পারে এবং পরবর্তী সরকারের করণীয় কী হওয়া উচিত, তা-ও শোনে। তারপর তারা ঘরে বসে হোক বা রাস্তার পাশের বটগাছের ছায়ার চা-দোকানে বসে হোক, বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, কাকে ভোট দেবে।

বঙ্গীয় রাজনীতিতে সে রকম প্রচারণার আর প্রয়োজন বোধ করেন না রাজনীতিবিদেরা। মানুষের মধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নেতারা সকালে ইনসুলিন নিয়ে মাংস-ডিম-পরোটা দিয়ে ভারী নাশতা করে এক মুঠো ট্যাবলেট গিলে কেউ খান প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে, কেউ রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে, কেউ বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টারে, কেউবা খামারবাড়ি। যাঁদের সংগতি কম, তাঁরা তোপখানা রোডের পাশে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে যান।

তবে নির্বাচন যে হবে, তা যাঁরা মহাসড়কে যাতায়াত করেন, তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন। পোস্টার-ব্যানারে আকাশ দেখা যায় না। একটিমাত্র দলের গণতন্ত্রকামীরা সড়কের বৃক্ষগুলোকে পেরেক ঠুকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছেন। আমরা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলি। বৃক্ষাধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তা নিয়ে পরিবেশবাদীরা নীরব। জগদীশ বসু বেঁচে থাকলে আজ সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং বলতেন, বৃক্ষেরও প্রাণ আছে। যার প্রাণ আছে, তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করার অধিকার তোমাদের নেই। তবে যাঁরা প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় মানুষের বুকে ও মগজে হাতুড়ি ঠুকতে পারেন, তাঁদের পক্ষে বৃক্ষের গায়ে পেরেক ঠোকা অতি সহজ।

অতীতের নির্বাচনগুলোর মূল থিম কী ছিল, তা নতুন প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। এবারের নির্বাচনের মূলমন্ত্র কী হবে, তা পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লেখকদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তা বলার কথা রাজনীতিজীবীদের। তাঁদের কারও বিবৃতি বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্যে ঠাসবুনট, কারও বক্তব্য গোঁফ না-ওঠা বালকের বাক্যের মতো। কারও এমন বক্তব্য, যার সব রকম মানে করা সম্ভব, কারও বক্তব্য পরাবাস্তববাদী কবিতার মতো, যার মাথা-মুণ্ডু নেই, কারও কথাবার্তা পাবনার মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসারত মানুষগুলোর মতো। যে সুস্পষ্ট বক্তব্য মাত্র এককথায় মানুষ শুনতে চায়, তা বেরোচ্ছে না কারও মুখ থেকে।

বেশি দেরি হয়ে গেছে। আর সময় নেই। এখন এককথার সময়, হেঁয়ালি বা ধাপ্পা দেওয়ার দিন শেষ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক