Thank you for trying Sticky AMP!!

কবে নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত হবে?

আকা: তুলি

ফেব্রুয়ারির পয়লা সপ্তাহে নেপালের কারভে জেলার পাহাড়ের ঢালে একটা পান্থনিবাসে দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের একটা সভা অনুষ্ঠিত হলো। এঁরা সবাই ‘দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য বিমোচন জোট’-এর সদস্য। এ অঞ্চলে এ ধরনের অনেক সংগঠন বা নেটওয়ার্ক আছে। প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করে। উল্লিখিত জোটটির মূল লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অনুকূল রাজনীতির প্লাটফর্ম তৈরিতে সাহায্য করা। এর সদস্যরা এসেছেন সমাজের বিভিন্ন স্রোতোধারা থেকে। তবে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এঁরা ১২ বছর ধরে এ জোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন তার মূল প্রতিপাদ্য হলো উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা, সমাজের অবহেলিত অংশের প্রতি দায়িত্ববোধ ও তাদের সহযাত্রী হওয়া এবং নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
এবারের আলোচনায় যা প্রাধান্য পেয়েছে তা হলো আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদ, মালদ্বীপে বিবদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, যা কিনা দুই আঞ্চলিক পরাশক্তির পারস্পরিক লড়াইয়ের একটা নতুন ক্ষেত্র, শ্রীলঙ্কায় উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদ, নেপালে ক্ষমতার লড়াই এবং সংবিধান প্রণয়নে অনিশ্চয়তা, ভুটানে রাজকীয় গণতন্ত্রের আড়ালে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের দেশছাড়া করা, ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান এবং বাংলাদেশে ভোটারবিহীন নির্বাচন। এ ধরনের সভায় ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে নিজেদের ‘কালো’ বিষয়গুলো ‘সাদা’ করে দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। সেই সুযোগটা থাকে সাধারণত আমলা ও রাজনীতিকদের মধ্যে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এখানে নিজেদের বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এখানে সবাই দক্ষিণ এশীয়। তাই ধর্মীয় ও আঞ্চলিক উগ্রবাদের মোড়কে একজন ইমরান খান কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা উগ্র জাতীয়তাবাদের মোড়কে একজন রাজাপক্ষে কিংবা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদ হয় আধুনিক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। নেপালে একটা টেকসই সংবিধান তৈরির ব্যাপারে টালবাহানা থেকে একজন নেপালির সঙ্গে সঙ্গে একজন আফগান বা একজন বাঙালিও মনে কষ্ট পান। আবার ‘আম আদমি পার্টি’র আপাত সাফল্য দেখে এবং একজন অখ্যাত অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রথাগত রাজনীতিতে সামন্ত নেতাদের যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, তাতে সবাই আনন্দিত হন এবং একই সঙ্গে হন আশাবাদী।
নাগরিক সমাজের এ ধরনের সভা ও আলোচনার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত নন, তাঁদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন যে মুক্তমনের আধুনিক ও সংস্কৃতিমান মানুষ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে আছেন অনেক। তাঁরা নিজেদের নিছক পাকিস্তানি, বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় অথবা হিন্দু, মুসলমান কিংবা বৌদ্ধ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন না। একজন ব্যক্তির বহুমাত্রিক পরিচয় থাকতে পারে। তিনি একই সঙ্গে একজন বাঙালি কিংবা তামিল, অথবা হিন্দু কিংবা মুসলমান, অথবা দলিত কিংবা ভূস্বামী, অথবা নারী কিংবা পুরুষ। সব ছাপিয়ে তিনি একজন মানুষ। আর মানুষে মানুষে ভেদরেখা টানা অন্যায় ও অনৈতিক।
দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে এ অঞ্চলে এ ধরনের ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’ চলে আসছে দশকের পর দশক। এখানে সামন্ত প্রভুরা গণতন্ত্রের উর্দি পরে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় চিরস্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার জন্য মানুষকে বিভক্ত করেন, তাঁদের নিয়ে দলাদলি করেন, বিভিন্ন নামের তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করেন এবং অবশেষে তাদের ব্যালট পেপারটি নিজের আঁচলে কিংবা পকেটে পুরে জনগণের কাঁধে সিন্দবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসেন। এই একই গল্প টেকনাফ থেকে হিরাটে, লাদাখ থেকে মালে পর্যন্ত।
কয়েক দশক ধরে আমরা একটা কথা শুনে আসছি: ‘ট্রান্স-বর্ডার ডেমোক্রেসি’। মোদ্দা কথা হচ্ছে, গণতন্ত্র এমন একটা চলমান প্রক্রিয়া, যা সীমানা মানে না। অথবা বিষয়টা এমন করে ব্যাখ্যা করা যায়: একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে গণতন্ত্র পুরোপুরি বিকশিত হয় না, তা ডালপালা মেলে বড় হতে পারে না। এখানে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শর্তগুলো পরস্পরের ওপর অভিঘাত ফেলে। একটি দেশে যদি গণতন্ত্রের বিকাশ হতে থাকে, তা তার পাশের দেশের অবিকশিত গণতন্ত্রকে নানাভাবে সাহায্য করতে পারে। এ আন্তসীমান্ত গণতন্ত্রায়ণ আমরা ইদানীং লক্ষ করছি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে। এতে নাগরিক সমাজের অবদান অনেক।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০০১ সাল থেকে বিশ্ব সামাজিক সম্মেলন বা ‘ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রথম তিন বছর এটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্রাজিলের বন্দরনগর পোর্তো এলেগ্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। এটা হলো নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক সম্মেলন। পরপর দুই বছরের সম্মেলনের পরে দেখা গেল লাতিন আমেরিকাজুড়ে নাগরিক আন্দোলনের উল্লম্ফন। এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হলো ব্রাজিলের রাজনীতিতে। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা লুলা ডি সিলভা। সেই থেকে শুরু। একে একে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, পেরু ও আর্জেন্টিনায় নির্বাচিত হলো জনগণের সরকার। নতুন সরকারগুলো জানিয়ে দিল, ‘বানানা রিপাবলিকের’ দিন শেষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তর্জনী দেখে কেউ আর আগের মতো ভয়ে গুটিসুটি হয়ে যায় না।
দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা একটু আলাদা। দীর্ঘদিন উপনিবেশ থাকার কারণে এখানে ‘জাতীয়তাবাদ’ বেশ চড়া মেজাজের। নানাভাবে এ জাতীয়তাবাদের চারাগাছে জল ছিটানো হয়েছে। এর অনুষঙ্গ হিসেবে মনের মধ্যে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে বায়বীয় দেশপ্রেম, যা সীমান্তের অপর দিকের মানুষকে শত্রু হিসেবে ঘৃণা করতে শেখায়। এসব দেশে সুস্থ ও বিবেকবান মানুষের অভাব নেই। তাঁদের একদিকে নিজ নিজ দেশের সরকারের ও সামন্ত রাজনীতিকদের কাছে শুনতে হয় তাঁরা নাকি বিদেশি এজেন্ট! অন্যদিকে তাঁদের নিজেদের মধ্যে রয়েছে যোগাযোগের অভাব। বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং রাষ্ট্র আরোপিত নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বিবেক ও মননের লেনদেন করা সহজ নয়। সেই কাজটি করা খুবই জরুরি।
নেপালের পরিবেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো থেকে একটু আলাদা। এটাই এই অঞ্চলের একমাত্র দেশ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের নাগরিক আগাম ভিসা না নিয়ে প্রবেশাধিকার পান। তাই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা তাঁদের আঞ্চলিক সভাগুলো করার জন্য এই দেশটিকেই বেছে নেন। হিমালয়ের গৌরীশঙ্কর পর্বতচূড়ার পাদদেশে দক্ষিণ এশীয় দারিদ্র্য বিমোচন জোটের সভায় বসে অংশগ্রহণকারীরা এটাই ভাবছিলেন, কবে পুরো অঞ্চলটি তাঁদের নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত হবে? কাঁটাতার আর বর্ডার গার্ড দিয়ে মানুষকে আর কত দিন অবরুদ্ধ করে রাখা হবে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।