Thank you for trying Sticky AMP!!

কষ্টের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে কারা

সত্তর-আশির দশকের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক না। এমন একটা সময় ছিল, যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নসহ প্রায় সব সূচকে দেশ পিছিয়ে ছিল। আজ বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে মানুষ এখন এ দেশে আসছেন।

স্বাধীনতার পর প্রতি দশকেই দেশের কোনো না কোনো খাতে উন্নয়ন হয়েছে। এসবই ইতিবাচক। কিন্তু যখন দেখা যায়, কয়েক লাখ মানুষ বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাজ করেন, তখন সেটা ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে।

উন্নয়নের মধ্যেও সমস্যারও যেন শেষ নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো বেকার সমস্যা। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ কাজের বাজারে আসছেন। তাঁদের কয়েক লাখ কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। অন্যরা বেকার থেকে যাচ্ছেন। এই যখন বাস্তবতা, তখন বিদেশিরা এ দেশে অবৈধভাবে কাজ করবেন কেন?

২০১৫ সালে সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) একটি গবেষণা করেছিল। এ গবেষণা মতে, তাঁরা এক বছরে ভারতে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি দেশ থেকে ভারত যে মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আয় করে বাংলাদেশ থেকে। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৮ সালের একটি গবেষণা রয়েছে। এ গবেষণায় অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকেরা বৈধ পথে বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার নিজ নিজ দেশে পাঠান, টাকার অঙ্কে যা প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি।

উন্নয়নশীল সব দেশেই হয়তো কিছু অবৈধ বিদেশি শ্রমিক থাকেন। কিন্তু এর সংখ্যা খুবই কম। কোনোভাবেই সে সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে না। কিছু দেশের অনেক নাগরিক আছেন, যাঁরা ভ্রমণ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন, যা আইনত অবৈধ। নিশ্চয়ই এসব অবৈধ কর্মী এ দেশে কারও না কারও সহযোগিতা পান। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

যেসব বিদেশি এ দেশে কাজ করেন, তাঁদের অধিকাংশই কারখানার উৎপাদনকাজে জড়িত। তাঁদের বেতনও অনেক বেশি। কিছু বিশেষায়িত ক্ষেত্রে হয়তো বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটা সময়সীমা থাকা প্রয়োজন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজেদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু আমাদের সে রকম কোনো লক্ষ্য নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি এই লক্ষ্য অর্জনকে জরুরী করণীয় হিসেবে নির্ধারণ করেছে? করেনি বলেই বছরের পর বছর বিদেশিরা এ দেশে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। যে সব দেশ উন্নত হয়েছে, তাদের সরকারের পাশাপাশি নিয়োগদাতা কোম্পানিগুলি শিক্ষাঙ্গনে তহবিল সহায়তা দিয়ে এবং সরকারের নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে তাদের প্রয়োজনীয় কর্মশক্তির জোগানের ব্যবস্থা করেছে।

বিদেশিদের কাজের ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু কাজ বিদেশিরা করছেন, যে কাজ এ দেশের মানবসম্পদ দিয়ে করা সম্ভব। কয়েকটি ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং এজেন্সিতেও বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। এটা এমন কোনো টেকনিক্যাল কাজ না। কোনো উন্নত প্রযুক্তির কাজও না। এ ক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞানেরও দরকার নেই। তাহলে কেন এখানে বিদেশিরা কাজ করছেন? এ ধরনের কাজ সারা জীবন এ দেশের মানুষই করে এসেছে।

অধিকাংশ বিদেশি কাজ করেন রপ্তানিমুখী মাঝারি ও বড় কারখানায়। বড় ব্যবসায়িক গ্রুপেও বিদেশি কাজ করেন। সবচেয়ে বেশি বিদেশি কাজ করেন পোশাক কারখানা। এর প্রায় অর্ধেকই প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিক। আরও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কত বিদেশি অবৈধভাবে দেশে কাজ করছেন, এরও সঠিক কোনো হিসাব নেই। এভাবে রাষ্ট্র তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাঁদের বিভিন্ন অন্যায়-অপকর্মে লিপ্ত হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যাংকের এটিএম কার্ড জালিয়াতিতে বিদেশিদের দেখা গেছে।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি সদস্য রয়েছেন। তাঁদের পরিচালনা পর্ষদ পোশাক কারখানায় কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা জানতে চেয়ে সদস্যদের চিঠি দেয়। চিঠিতে বিদেশিদের নাম, পদবি, কোন বিভাগ, কাজের দক্ষতা, কত দিন ধরে করছে, জাতীয়তা ও মাসিক বেতন কত—এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। বিজিএমইএ মাত্র ৫২টি পোশাক কারখানা তথ্য পেয়েছে। সেখানে অবশ্য খুব বেশি বিদেশি কর্মীর তথ্য ছিল না।

ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, তাইওয়ান, ইরাক, আফগানিস্তান, তানজানিয়া, আফ্রিকাসহ ৪০ থেকে ৫০টি দেশের মানুষ বাংলাদেশে কাজ করেন। টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং—এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবৈধ বিদেশি কাজ করেন। এর বাইরেও আছে খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, ফার্নিচার কোম্পানি, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, চামড়াজাত, গবেষণ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

দেশে যেখানে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ কাজের বাজারে আসছেন। লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী রয়েছেন। একটা চাকরির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। সেখানে কেন যে কাজ এ দেশের মানুষ করতে পারেন, সে ধরনের কাজ বিদেশিরা করবেন? বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণজাত অঞ্চলে অনুমতি ছাড়া কোনো বিদেশি কাজ করতে পারেন না। নিয়ম সবার জন্য সমান।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে কয়েক লাখ বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বিভিন্ন ধারণা অনুযায়ী, স্থায়ী-অস্থায়ীসহ প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে থাকেন। এক হিসাবে দেখা যায়, বিদেশিরা আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যান। বাংলাদেশের কর্মীরাও বিদেশ থেকে টাকা পাঠান। ২০১৮ সালের তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার। উন্নত অর্থনীতির অথবা ধনী দেশের থেকে কম উন্নত দেশে রেমিট্যান্স আসা স্বাভাবিক, এর উল্টোটা হওয়া অস্বাভাবিক।

বিনা অনুমতিতে যে বিদেশি কর্মী কাজ করবেন, তাঁকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি কর্মীর কাজের সুযোগ বাড়তে থাকবে। আমাদের প্রবাসী কর্মীর সীমাহীন কষ্টে আয় করা টাকার একটা বড় অংশ আবার বিদেশিরাই নিয়ে যাবেন।

আশফাকুজ্জামান: সাংবাদিক