Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘুরেফিরে শুধু মায়ের কথাই

আট সন্তানসহ নূরজাহান সিরাজী

একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে গত বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আলবদর-প্রধান আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ বিচারের মাধ্যমে অন্যান্য বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত হবে। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র জাহীদ রেজা নূর ও সুরকার আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ লিখেছেন তাঁদের ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা ১৭ জুলাই অফিসে আসার কিছুক্ষণ পর ফোন পেলাম বিয়াসের (সাংবাদিক, প্রকৃতিবিদ মরহুম তোহা খানের ছেলে)। ও একটি শব্দই উচ্চারণ করল, ‘ফাঁসি’। আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে, এ খবর পেয়েই মনে পড়ল আমার মা নূরজাহান সিরাজীকে। মা রায়টি শুনে যেতে পারলেন না। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর তিনি চলে গেছেন। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর আমার বাবা দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আলবদর বাহিনী। এর পর থেকেই আমার মা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কী অসহায় জীবনযাপনই না করে গেলেন!

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লিখেছিলাম প্রথম আলোর অনলাইনে। ঘুরেফিরে শুধু মায়ের কথাই এসেছিল সে লেখায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই লেখাটির ব্যাপারে যে মন্তব্যগুলো আসতে থাকল, তাতে অবাক হলাম। একজন মানুষের একেবারে ব্যক্তিগত অনুভূতি মানুষকে এতটা আকৃষ্ট করে! এখন বুঝতে পারছি, আমার অনুভূতি একান্ত নিজস্ব হলেও তা তো আসলে ৩০ লাখ শহীদ পরিবারকে নিয়ে যে মহাকাব্য, তারই অংশমাত্র। এই একই অনুভূতি এদের সবার। এ ছাড়া যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করেন, তাঁরাও তো এই অনুভূতির অংশীদার।
লিখেছিলাম, নূরজাহান সিরাজী, বাবার আদরের ‘নূরী’ আমাদের চলার পথকে সহজ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন। বাবাকে হারানোর বছর কুড়ি পরে যখন একটু একটু করে অভাব কেটে যেতে থাকল, তখন আমরা চেষ্টা করেছি মাকে একটু ভালো কিছু খাওয়াতে। কিন্তু এত দিনের অভ্যাসের কারণে বাসি খাবারই খেয়ে গেছেন তিনি। সবার খাওয়া শেষে যা বাঁচত, সেটাই ছিল মায়ের খাওয়া। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চাহিদাহীন ছিলেন তিনি। ‘ছোট্ট একটা শরীরে কী অসাধারণ শক্তি ধারণ করতেন নূরজাহান সিরাজী! ভাবতে অবাক লাগে, দুঃসময় পাড়ি দেওয়ার সময় কখনোই আমাদের ভেঙে পড়তে দেননি। ঈদের সময় আমরা ছোট তিন ভাই-ই কেবল পেতাম নতুন জামাকাপড়। আগের বছরে বানানো ট্রাউজার তত দিনে গোড়ালি ছেড়ে ওপরে উঠে আসত। আমরা ছিলাম বাড়ন্ত, তাই নতুন জামাকাপড় না দিলে পরার মতো কিছু থাকত না। মনে পড়ে, এক ঈদে আমাদের তিনজন ছাড়া শুধু সেলিম ভাইকেই (পঞ্চম ভাই) ফুটপাতের ঝুড়ি থেকে ৪০ টাকা দিয়ে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বড় তিন ভাইয়ের দুজন বাইরে গেলে তৃতীয় জনকে বসে থাকতে হতো বাড়িতে, কারণ বাইরে যাওয়ার পোশাকই ছিল দুজনের মতো। সোহাগ পরিবহনে যখন গ্রামের বাড়ি মাগুরার শরুশুনা গ্রামে যেতাম, তখন আমাদের পরিবার বাদে অন্য সবাইকেই সকালের নাশতা দিত পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ছোট আমরা অবাক হয়ে অন্যদের নাশতা খাওয়া দেখতাম। টিকিট কাটার সময় ওই নাশতার টাকাও জোগাড় করা যেত না বলে কম দামে নাশতা ছাড়া টিকিটই কাটতে হতো। আমার মা এসবই সহ্য করেছেন। তখন তাঁর চোখের জল কীভাবে লুকাতেন মা, জানতে ইচ্ছে করে।’
বেশির ভাগ শহীদ পরিবারের জীবন-নাটকের চিত্র এ রকমই। আমরা ব্যতিক্রম নই। মা যেমন মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘তোর বাবার খুনের কি বিচার হবে না?’ সেই একই প্রশ্ন সকল শহীদের সন্তানেরাই শুনেছেন তাঁদের মায়ের কাছ থেকে। আমরা কেউই কোনো উত্তর দিতে পারতাম না। কারণ, তত দিনে টেলিভিশনের কল্যাণে শহীদজায়ারা দেখেছেন মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা।
আমার মনে পড়ে, বছর পাঁচেক আগে শহীদ মিনারে ২৫ মার্চ কালরাতে আমার মা মশাল জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বারবার গেছেন স্মৃতিসৌধে। রক্তচাপ আর হূৎপিণ্ডের অসুখ তাঁকে নিরস্ত করতে পারেনি। আমরাই বকা দিতাম, ‘কী করছেন মা, আপনার এখন বাড়িতে রেস্ট নেওয়া দরকার।’ অসহায়ভাবে আমাদের দিকে তাকাতেন। সেই অসহায় চাহনির এমন শক্তি ছিল যে, আমরাই বিব্রত হতাম। বুঝতাম, আমরা হারিয়েছি বাবাকে, তিনি হারিয়েছেন স্বামীকে। ৩২ বছর বয়সে আট সন্তানকে নিয়ে তিনি বিধবা হয়েছেন। ছেলেরাই তাঁর জীবন। কিন্তু যখনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে, তখন তাঁর অন্য রূপ। ৪২ বছরের সংগ্রামী জীবনে তিনি বারবার স্বামী হত্যার বিচার চেয়েছিলেন। তাই, তাঁকে রাজপথে দাঁড়ানোয় বাদ সাধিনি আমরা।
আমি আমার মা নূরজাহান সিরাজীকে বলব, ‘মা, ৪২ বছর আপনি যে যন্ত্রণা ভোগ করে গেছেন, তা লাঘব করতে পারিনি আমরা। আমাদের ক্ষমা করুন। কিন্তু মুজাহিদের ফাঁসির রায় শোনার পর আপনার মুখটাই সবার আগে মনে ভেসে উঠল কেন, সেটাও বোঝার চেষ্টা করুন। এবার যখন মিরপুরে আপনার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াব, তখন এই আমি বা আমরা ভাইয়েরা অন্তত আপনাকে বলতে পারব, মা, আপনার প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। আফসোস, আপনি শুনে যেতে পারলেন না।’
আমার মায়ের মতো যাঁরা বিচারের রায় দেখে যেতে পারেননি, তাঁদের সবাইকেই আমি বলব, ‘মা, আপনাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে।’ আর যে মায়েরা বিচার দেখে যেতে পারলেন, তাঁদের প্রতি নত হয়ে বলব, ‘মা, একটি মহাকাব্যের শেষ অঙ্কের কলঙ্কিত ধোঁয়াশা থেকে আপনারা মুক্ত হলেন। নিভৃতে আপনারাও হারানো প্রিয়জনের উদ্দেশে বলতে পারবেন, তোমাকে যারা হত্যা করেছিল, তারা শাস্তি পেয়েছে।’
জাহীদ রেজা নূর: শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র। সাংবাদিক।