Thank you for trying Sticky AMP!!

টিকফা চুক্তিতে বাংলাদেশই লাভবান হবে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা কাঠামো (টিকফা) চুক্তির খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেল গত সোমবার। বহু বছর ধরে ঝুলে থাকার পর শেষমেশ একরকম সুরাহা হওয়াটা অবশ্যই স্বস্তির। তবে আমি আজও বুঝতে পারি না, এটি কেন এত বছর ঝুলে ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কিছুই নেই। আছে যা, তা হলো উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের দিকনির্দেশনা। সম্ভাব্য চুক্তির খসড়াটি এতটাই সাদামাটা ও নিরীহ গোছের যে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা একবারেই অবান্তর। খসড়া তো আগলে রাখা হয়নি, গোপন করেও রাখা হয়নি। অন্তত এবার চুক্তির খসড়ায় কী আছে, চাইলেই যে কেউ দেখতে পারেন। মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের আগে এর সার্বিক দিক নিয়ে পত্রপত্রিকায়ও বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আলোচনা হয়েছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও।

এটা ঠিক, ২২ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, তার সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে দর-কষাকষি ও আলোচনার জন্য আদতেই আনুষ্ঠানিক কোনো ফোরাম বা প্ল্যাটফর্ম নেই। এযাবৎ ৯২টি দেশ ও আঞ্চলিক জোটের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভুটান ও বাংলাদেশই শুধু এখনো বাকি।

টিকফার আগে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কাঠামো চুক্তি (টিফা) করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছিল ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন একটি খসড়াও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আর চুক্তি হয়নি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের মার্চে আলোচনা উঠেও আবার থেমে যায়। শেষমেশ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের আগস্টে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন। এর পর থেকেই বিষয়টি এগোতে থাকে।

আমার প্রশ্ন হলো, মন্ত্রিসভায় সদ্য পাস হওয়া খসড়ায় যা আছে, ১০ বছর আগের খসড়ায়ও তা-ই ছিল। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রায় একই ধরনের কাঠামো তৈরি করেছে। বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন ধরনের কোনো ভাষা বা শর্ত নেই। এর পরও এ নিয়ে সমালোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

টিকফা কী এবং কী উদ্দেশ্যে তা করা হচ্ছে, একটু তলিয়ে দেখলেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ়, বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই টিকফা হচ্ছে। বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গেই তা করতে তো বাধা থাকার কথা নয়, নেইও। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাধা থাকবে কেন।

এখন দেখা যাক খসড়ায় কী আছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উভয় দেশের মধ্যে একটি উদার ও অনুধাবনযোগ্য পরিবেশ তৈরির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এর ফলে সম্প্রসারিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ হবে এবং এ থেকে লাভবান হবে উভয় দেশ। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পথে বর্তমানে যেসব প্রতিবন্ধকতা এবং রক্ষণশীল উপাদান রয়েছে, সেগুলো কমিয়ে আনা হবে—এ কথাও বলা হয়েছে।

আরও বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে উভয় পক্ষই জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের প্রতি আনুগত্য দেখাবে। বিশেষ করে কনভেনশনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগসম্পর্কিত ধারাগুলো অনুসরণ করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। দেশীয় ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করা হবে, যাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হয়।

এ ছাড়া উভয় পক্ষের সেবা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা দূর করা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মূলনীতি অনুসরণ করে উভয় দেশেরই শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন করা এবং পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ করতে পরিবেশ আইন মেনে চলার কথাও বলা আছে এ খসড়া চুক্তিতে।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই এগুলোর স্বীকৃতি দিয়েছে। এরপর কী হবে? টিকফা নামে একটি ফোরাম গঠিত হবে। বছরে কমপক্ষে একবার বৈঠক করবে এ ফোরাম। বাংলাদেশের পক্ষে এতে প্রতিনিধিত্ব করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর)।

এ ফোরাম উভয় পক্ষের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করবে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা চিহ্নিত করবে। এ ছাড়া উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র চিহ্নিত করবে এ ফোরাম। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেগুলো অপসারণেও পদক্ষেপ নেবে। প্রয়োজনে বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের পরামর্শও চাইবে এ ফোরাম। অর্থাৎ সরকারের পাশাপাশি নাগরিক পর্যায়েও এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকবে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, এক দেশ আরেক দেশকে লিখিত নোটিশ দিয়ে চুক্তি বাতিল করতে পারবে যেকোনো সময়। অর্থাৎ যে পক্ষ চুক্তি বাতিলের নোটিশ দেবে, সেই পক্ষ যদি তা প্রত্যাহার না করে নেয়, তাহলে ১৮০ দিনের মধ্যে চুক্তিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।

একসময় আমারও সন্দেহ ছিল আগের টিফা নিয়ে। কী সর্বনাশই না হয়ে যায়! টিফার বদলেই তো টিকফা হয়েছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে দেখেছি এর খসড়া। আমি অসংগতি বা আপত্তির কিছু দেখিনি। বারবার পড়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরীক্ষা করে দেখেছেন। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরাও দেখেছেন। দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু নেই এ চুক্তিতে। সবকিছু দেখেশুনেই চুক্তির খসড়া মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়েছিল।

আসলে আমি যেটা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভালো চায়। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাঙালি কর্মঠ ও দক্ষ জাতি। দেশটি আমাদের সাহায্য করতে চায়। আমরা না বুঝে অনেক বিরোধিতা করলেও এ ব্যাপারে তারা যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। ধন্যবাদ জানাই যুক্তরাষ্ট্রকে। আমরা যেভাবে চেয়েছি, অনেক ছাড় দিয়েও তারা সেভাবেই রাজি হয়েছে।

এ দেশের অনেকেই বিরোধিতা করছেন টিকফা নিয়ে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের দিনই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল বিবৃতি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বলেছে, টিকফা হলে দেশ যুক্তরাষ্ট্রের করায়ত্তে চলে যাবে। আমি তাদের দোষারোপ করছি না। তাদের দেশপ্রেম নিয়েও আমার সন্দেহ নেই। হয়তো দেশের প্রতি মায়া ও দরদ থেকেই তারা এ অনুভূতি প্রকাশ করছে।

আমার ধারণা, তারা হয়তো চুক্তির খসড়া না পড়েই এ ধরনের কথা বলছে। আমি তাদের চুক্তিটি ভালো করে পড়ার অনুরোধ জানাব। আসল কথা হলো, টিকফার খসড়াটি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সহজ, সুন্দর ও জটিলতাহীন চুক্তি হবে এবং যা থেকে মূলত বাংলাদেশই বেশি লাভবান হবে।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের: বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশসরকার।