Thank you for trying Sticky AMP!!

তুফান হয় বালাসোরে, বাঁধ ভাঙে বরগুনায়

উপকূলের তামাম মানুষকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেতে আটকিয়ে রেখে অভূতপূর্ব ভোগান্তিতে ফেলার কোনো জবাব নেই।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানির চাপে পদ্মা পয়েন্টের ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। গতকাল বরগুনার পাথরঘাটায়

সাগর থেকে উঠে ২৬ মে সকালেই ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের মূল চক্রটা চলে গেছে ভারতের ওডিশার বালাসোরের দিকে। কিন্তু তার প্রভাবে আমাদের উপকূল এক চরম সর্বনাশের আশঙ্কায় দুলতে থাকে। ঝুপঝাঁপ করে ভেঙে যেতে থাকে একের পর এক বাঁধ। কলকাতার টালিগঞ্জের চরিত্র ফাটাকেষ্টর বিখ্যাত সংলাপ, ‘মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’ যেন আওড়ে চলে ইয়াস। ২৬ মে সন্ধ্যার মধ্যেই গোটা পাঁচেক লাশের খবর পাওয়া গেছে। এ লেখা আলোর মুখ দেখতে দেখতে লাশের সংখ্যা দুই ডিজিটে চলে যেতে পারে। অথচ যেখানে আছড়ে পড়েছে ইয়াস, সেখানে তখনো লাশ হয়েছে মাত্র দুজন।

অপ্রস্তুত নারী-পুরুষ বিনা নোটিশে যখন ঘরবাড়ি হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ব্যস্ত, তখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ২৬ মে বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে বসে ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ঝুঁকিতে নেই। এটি বাংলাদেশে আঘাত করেনি। ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে ওডিশায় আঘাত করেছে। উপকূলের তামাম মানুষকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেতে আটকিয়ে রেখে তাদের এ অভূতপূর্ব ভোগান্তিতে ফেলার কোনো জবাব নেই। ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত মানে সাগরপারের বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিলোমিটার হতে পারে। বন্দরে ৪০-৫০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে, তাতে মোরেলগঞ্জের খাদ্যগুদামের কী? মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ২ নম্বর ফেরিঘাটের পন্টুনের কী যায় আসে? হাতিয়ার সুখচর ইউনিয়নে সাত বছরের মিষ্টি মেয়ে লিমা আকতারের তাতে তো ভেসে যাওয়ার কথা নয়। পটুয়াখালীর দুমকিতে বাড়ির পাশে অন্য দিনের মতো হোগলা পাতা কাটতে গিয়ে হঠাৎ জোয়ারে কেন ভেসে যাবেন ৫৫ বছরের হাচিনা বেগম।

পাথরঘাটার পশ্চিম কাঁঠালতলী, উত্তর কাঁঠালতলী, পদ্মা ও জিনতলা বেড়িবাঁধ কেন ভেঙে যাবে সুদূর ওডিশার বালাসোরের এক মাঝারি মাপের ঝড়ে আমরা যখন কেবলই ৩ নম্বর সতর্কে আছি।

সাতক্ষীরার ১২টি ইউনিয়নের ২১টি গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সেখানে ৩৫ হাজার পরিবারের দুই লাখ মানুষ এখন কোথায় যাবে?

মন্ত্রীর কথিত ‘আঘাত’ না করলেও মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। (আসলে এখনো সঠিক পরিমাপ কারও জানা নেই। মাঠে থাকা পানি প্রকৌশলীদের প্রাথমিক খালি চোখের হিসাব অনুযায়ী এটা কয়েক শ কিলোমিটার হতে পারে। বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের ৬ জেলায় ৮৮ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের হিসাব এর সঙ্গে যুক্ত হবে)। এ ছাড়া পানি ব্যবস্থাপনার আরও ৪৫টি অবকাঠামো ও নদীতীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৪টি জেলায় বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন স্থাপনায় জোয়ারের পানি ঢুকেছে। জানানো হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে কাজ করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো পরিকল্পনার কথা এখনো প্রকাশ পায়নি। লিখতে বসে (২৭ মে) ফোনে ফোনে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ আর বুড়িগোয়ালিনী থেকে খবর পেলাম, ইউনিয়নপ্রতি আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করার চটজলদি আদেশ প্রচার করা হয়েছে। এটাকে অনেকেই ‘টু লিটল টু লেট’ বলবেন। কিন্তু জবাবদিহিবিহীন আমলাসর্বস্ব কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাপনায় এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা বৃথা। এ ব্যবস্থার দম কম জোরে ছুটতে পারে না।

সাতক্ষীরার খোলপেটুয়া নদীর নড়েরাবাদে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আশাশুনি উপজেলার বড়দল ইউনিয়নে

কেন এমন হাল হলো

ইয়াস গোপনে আসেনি। জানান দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে দিনক্ষণ জানিয়েই এসেছিল সে। ৩০ বছর পর জোয়ারের সময় আকাশ থেকে নামার কথা দিয়েছিল সে। তা–ও আবার বৈশাখী পূর্ণিমা আর চন্দ্রগ্রহণের লগ্নে। ঝড় ছাড়াই সাগর তখন উত্তাল থাকে, বেড়ে যায় জোয়ারের উচ্চতা। এই সময় সাগরে যেকোনো ঝড় তার বেগ–আবেগ যা–ই থাকুক না কেন, ধ্বংসের ক্ষমতায় সে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে বিপদের বার্তা মানুষের জন্য (শুধু জাহাজঘাট আর জাহাজের জন্য নয়) জনপদের জন্য তৈরি আর প্রচার করতে আমরা কবে শিখব?

বাতাসের গতিবেগ নিয়ে মানুষের কোনো হেলদোল নেই। আর সে বাতাস কোন বন্দরের ডানে কি বাঁয়ে দিয়ে যাবে, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। তাঁরা কেবলই জানতে চান ‘পানি কতটা হবে?’ আমার উঠানে থাকবে না ঘরে ঢুকবে, নাকি চালটাও ডুবে যাবে? আর সময়টা কখন?’ এসবের সব উত্তর ছিল সবার স্মার্টফোনে, ল্যাপটপে। জানা ছিল আবহাওয়া অফিসেরও। জেলা–উপজেলার মালিক প্রশাসক, যাঁর পকেটেই সরকারের দেওয়া জনগণের পয়সায় কেনা স্মার্টফোন আছে। তিনি অন্তত ৩৬ ঘণ্টা আগে জানতে পারতেন কোন এলাকায় কত ফুট পানি কখন আসতে পারে। মুশকিল হচ্ছে আমাদের সরকারি ঝড় মাপা তরিকার বাইরে শত প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও কারও মুখ খোলার জো নেই, দায়ও নেই। এককেন্দ্রিক যান্ত্রিক কেতাবি ব্যবস্থাপনা শুধু ঝড়ের বেগ আর তার পতনের ওপর নির্ভর করেই আভাস–পূর্বাভাস দেওয়ার যে নিয়ম চালু আর শুধু প্রচারের যে কর্তৃত্বসর্বস্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে, তার বাইরে গিয়ে কারও কিছু করার বা বলার সিদ্ধতা নেই। বৈধতাও নেই।

যেখানে চাপ নেই, নম্বরভিত্তিক সতর্ক আর সাবধানতার সার্কাস নেই, নেই বাঁধের বুজরুকি, সেখানে মানুষ অবাক করে দেওয়ার মতো কাজ করেছে। ২৪ তারিখ রাতে হাতিয়ার দক্ষিণে নিঝুম দ্বীপে কথা হয়েছিল। জালালুদ্দিন ভাইসহ যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বা ক্ষুদ্রঋণের ফাঁস থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের পুঁজি দিয়ে পুকুরে মাছ চাষ করছিলেন, তাঁরা সবাই পুকুর সেচে বড় মাছ সব তুলে নিয়েছেন। আট–দশ টন মাছ আড়তে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় দাম পেয়েছেন ভালো। হাসেম মাঝি পরিষ্কার জানালেন, ‘৩ নম্বর হোক, নম্বর ছাড়াই হোক, তুফান যখন ছাড়ছে, তখন নিঝুম দ্বীপে পানি উঠবে, জোয়ারের সময় হাত দশেক পানি আর সঙ্গে বাতাস ছাড়লে একানব্বই ছাড়ায় যাবে। তাই আমরা মাছ বেইচ্যা ফ্যালাইছি, ঠিক করছি না?’ এটাই লোকজ্ঞান কমন সেন্স (এটাকেই বলা যায় কাণ্ডজ্ঞান)। এটা সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরিশালেও ঘটতে পারত, কেন ঘটেনি? সেটা নিয়ে গবেষকেরা ভাববেন। এখানে কি মাথার মধ্যেই একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ‘সবে তো ৩ নম্বর আর একটু দেখি, এর চেয়ে বড় বড় নম্বরে যখন কিছু হয়নি, তখন ৩ নিয়ে এত ভাবনা কেন? এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার হুকুম তো আর হয়নি।’

এখন কী করা

ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েও ফেল করার আফসোস আমাদের থেকেই যাবে। তবে যেসব মানুষ এখন লবণ জলে হাঁসফাঁস করছেন, খাবি খাচ্ছেন, তাঁদের কী হবে। ‘আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি’ বলে ডেল্টা প্ল্যানের ঢেকুর তুললে তাদের গলা দিয়ে ভাত নামবে না। শাণবাঁধানো শক্ত কংক্রিটের বাঁধের গল্পে তাঁদের পেট ভরবে না। কিছু কাজ আছে তা আগামী অমাবস্যার আগেই শেষ করতে হবে। অমাবস্যার জোয়ারে আবার যেন লোকালয়ে লবণপানির বান না ডাকে, সেই জন্য বাঁধগুলো মেরামত করতে হবে। কোভিড আক্রান্ত শহরে কাজ নেই, অনেক মানুষ এখন গ্রামে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে ভাটার সময় মেরামতের কাজ শেষ করতে হবে। গাবুরার শত শত নারী–পুরুষ জনৈক চৌকিদারের এক বাঁশিতে জড়ো হয়ে রাতদিন বাঁধ রক্ষার কাজ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের বড় কোনো নেতা বাঁশি দিলে মানুষের অভাব হবে না, তবে তাঁকে ওই বাকি বেতনে কাজ করা চৌকিদারের মতো মানুষের পাশে থাকতে হবে সারা দিন, সারারাত।

আমরা জানি, সাগরের পানি সবচেয়ে লবণাক্ত থাকে জ্যৈষ্ঠ মাসে। সেই পানি ঢোকে জনপদে। তাই বাঁধ মেরামতের পাশাপাশি লোকালয়ে ঢুকে যাওয়া সাগরের বিষপানি, বিশেষ করে পুকুর আর জলাধারে আটকে যাওয়া সাগরের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে এখনই। সারা দেশে বোরো খেতে ব্যবহৃত সেচযন্ত্রগুলো এ কাজে ব্যবহার করা যায়। সুন্দরবনের জলাধারগুলোকেও এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ইতিমধ্যে ডায়রিয়া স্মরণকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। লবণপানির কারণে তা আরও বেড়ে যাওয়ার
আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। লবণাক্ত পানিতে কলেরা জীবাণু অনেক বেশি সময় সক্রিয় থাকে। এসব দিক মাথায় রেখে লবণাক্ততামুক্ত নিরাপদ পানির সরবরাহ বাড়াতে হবে। লবণপানিতে প্রচলিত ‘ওআরএস’–এর কার্যকারিতা হ্রাস পায়। সেখানে ঘরে তৈরি লবণ ছাড়া চালের গুঁড়ার স্যালাইন অনেক বেশি কার্যকর। এসব তথ্য মাঠপর্যায়ে আরও প্রচার করা প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক। nayeem 5508 @gmail. com