Thank you for trying Sticky AMP!!

দখলদার চক্র ও নিপীড়িত পানপুঞ্জি

খাসি জনগোষ্ঠীর পানপুঞ্জি পরিদর্শন করে আসা নাগরিক প্রতিনিধি দল ১৫ জুন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে। ।

খাসি জনগোষ্ঠী পাহাড়-টিলায় গড়ে তোলা নিজেদের গ্রামকে ‘পুঞ্জি’ বলেন। লতানো গাছ পানসহ দেশীয় বৃক্ষ প্রজাতিতে ভরপুর থাকে খাসি ও মান্দি জনগোষ্ঠীর এসব পুঞ্জি। কিন্তু সিলেট বিভাগের আদি পানপুঞ্জিগুলো আর আগের মতো থাকতে পারছে না। মূলত, চা–বাগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে উপ-ইজারা নেওয়া এসব পুঞ্জি থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে আদি বাসিন্দাদের। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের লাগানো বহু প্রাচীন বৃক্ষ ও পানগাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। চা নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিবছর প্রতিটি চা–বাগানের আড়াই শতাংশ বাগান সম্প্রসারণের নামে বৃক্ষসম্পদে ভরপুর আদি এই বসতিগুলো চরম হুমকিতে আছে।

শ্রীমঙ্গলের নাহারপুঞ্জি এবং কুলাউড়ার ঝিমাইপুঞ্জিতে গাছ কাটা ও উচ্ছেদের বিষয়টি জনপরিসরে বেশ সাড়া ফেলেছিল। তখন আদালত রায় দেন, উল্লিখিত পুঞ্জিগুলোর কোনো ক্ষতি করা যাবে না। কিন্তু সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও বড়লেখার বেশ কিছু খাসিপুঞ্জি বহিরাগত ব্যক্তিরা এসে দখল করেছে এবং নির্বিচারে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। প্রশাসন তৎপর হয়ে বড়লেখার বনখলাপুঞ্জির জবরদখলকৃত জায়গা দখলমুক্ত করে আবারও খাসিদের বুঝিয়ে দিয়েছে। সামগ্রিক বিষয়টি বোঝার জন্য ৭ থেকে ৮ জুন ঢাকা থেকে মানবাধিকারকর্মী, পরিবেশকর্মী, শিক্ষক, আদিবাসী সংগঠক, গবেষক ও সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদল ক্ষতিগ্রস্ত পুঞ্জিগুলো পরিদর্শন করে। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী, স্থানীয় প্রশাসন, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে কথা বলে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণিত আমাদের এই যৌথ বয়ান।

কাঁকড়াছড়াপুঞ্জি ও উদ্বাস্তু ৩০ পরিবার
দীর্ঘ পাহাড়ি টিলাপথ আর চা–বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে হয় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সদর ইউনিয়নের ছোট্ট পানপুঞ্জি কাঁকড়াছড়ায়। ২০১৩ সালে শেষ হওয়া পুঞ্জির উপ-ইজারা চুক্তি নবায়ন করেনি রেহানা চা–বাগান কর্তৃপক্ষ। তারা নির্বিচারে গাছ কেটে সেখানে চায়ের চারা গাছ লাগিয়ে দেয়। এভাবে বহু উৎপাদনক্ষম পান ও ফলের জুম দখল করেছে কর্তৃপক্ষ। জীবিকা হারিয়ে ৪৭ পরিবারের ভেতর ৩০ পরিবার উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়েছে। এখন মাত্র টিকে আছে ১৭ পরিবার। পুঞ্জিতে ঢোকার মুখেই একটা খেলার মাঠ। সেটির চারদিকেও চায়ের চারা গাছ লাগানো হয়েছে। পুঞ্জির একমাত্র কবরস্থানটি দখল করে বাগান সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পুঞ্জিবাসীর পানীয় জলের একমাত্র উৎস কুয়াটিও নষ্ট করছে চা–বাগান কর্তৃপক্ষ। পুঞ্জিবাসী মিন্টু রেমা পরিবারের দুই একর পানজুম ছিল। জুমের প্রায় ৬৭০টি বড় গাছই কেটে ফেলেছে চা–বাগান কর্তৃপক্ষ। দখল করে নিয়েছে তাঁর জুমের জমি। জুমচাষি থেকে মিন্টু রেমা এখন দিনমজুর।

আগারপুঞ্জি ও সহস্র পানগাছের মৃত্যু
বড়লেখার আগারপুঞ্জির কেটে ফেলা সহস্র পানগাছের স্তূপের কাছে যখন আমরা পৌঁছাই, বোঝা যায় কী নিষ্ঠুরতা চলছে এখানে। কাটা গাছগুলোর শোকে পানজুমের মালিক রিনুস পডুয়েং ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। পুঞ্জিবাসীর সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, কেবল করোনাকালেই নয়, এর আগেও দুর্বৃত্তরা তাঁদের গাছ ও পানজুম কেটে ফেলেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে নালিখাইপুঞ্জির পানজুম ও বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২০১৫ সালের নভেম্বরে আগারপুঞ্জির কয়েক শ পানগাছ কেটে বিনাশ করে।

বনাখলাপুঞ্জি দখল ও প্রশাসনের তৎপরতা
বড়লেখার সীমান্তবর্তী শাহবাজপুর ইউনিয়নে ২০০৭ সালে খাসিরা ছোটলেখা চা–বাগান থেকে ২৭২ একর জমি ইজারা নিয়ে ‘বনাখলাপুঞ্জি’ গড়ে তোলে। ছোটলেখা চা–বাগান কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে ১ হাজার ৯৬৪ দশমিক ৫০ একর টিলাভূমি চা–বাগানের জন্য ইজারা নিয়েছিল। সেই জমি থেকেই কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে খাসিদের উপ-ইজারা দেয়। ২০২১ সালের ২৮ মে পুঞ্জিটির প্রায় ৭০ একর জায়গা দখল করে বাইরে থেকে আসা বাঙালিরা। পুঞ্জি দখল বিষয়ে পুঞ্জিপ্রধান নরা ধার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন এবং চা–বাগান কর্তৃপক্ষ মামলা করে।

খাসিপুঞ্জিগুলোয় হামলা ও জবরদখল বিষয়ে সাধারণত কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় না, দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হয় না। কিন্তু বনাখলার ঘটনায় প্রশাসন বেশ তৎপর হয়েছে। জবরদখলের এক সপ্তাহ পর বড়লেখা উপজেলা প্রশাসন বনাখলা পানপুঞ্জির জায়গা দখলমুক্ত করেছে। বড়লেখা উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের যৌথ অভিযান চালিয়ে বনাখলাপুঞ্জিতে জবরদখলকারীদের নির্মিত ঘর উচ্ছেদ করেছে। প্রশাসনকে আবারও ধন্যবাদ প্রান্তজনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

পানপুঞ্জির অবদান ও স্বীকৃতি
মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের খাসি ও মান্দিরা মূলত বন বিভাগ, চা–বাগান এবং কিছু খাসজমি এলাকায় বসবাস করেন। খাসিদের বিশেষ পানজুম স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে এক সবুজ আবহ তৈরি করে। কেবল জীবন–জীবিকা নয়, এই পানজুম ব্যবস্থাপনা পরিবেশ সংরক্ষণে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সেখানকার প্রাকৃতিক ছড়া আবর্জনামুক্ত। পুঞ্জি সফরের সময়েই আমরা বহু বাঙালিকে দেখেছি পান ক্রয়, পানজুমে কাজ এবং নানা কিছু বিক্রি করতে পানপুঞ্জিগুলোয় এসেছেন। এ রকম বহু বাঙালি এবং চা–বাগানের গরিব মানুষ এসব পানপুঞ্জির ওপর নির্ভরশীল।

পানপুঞ্জির পরিবেশবান্ধব চাষপদ্ধতিকে গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করা জরুরি এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও বরাদ্দও জরুরি। পানপুঞ্জিগুলো পরিবেশ সুরক্ষা করে জীবন–জীবিকার যে ধরন তৈরি করেছে, তা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এই বিপন্ন সময়ে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। চা–বাগান সম্প্রসারণ কিংবা অন্যায় জবরদখলের মাধ্যমে এমন অনন্য উদাহরণগুলো যাতে হারিয়ে না যায়, এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাই। জবরদখল বা পানজুম ধ্বংস নয়, উৎরামের মতো পানের রোগের জন্যও অনেক সময় পুঞ্জি ছাড়তে হয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের।

পাশাপাশি জলবায়ুজনিত অনাবৃষ্টি ও তীব্র দাবদাহও সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।
পানপুঞ্জির জীবন–জীবিকা নিশ্চিতকরণ এবং সামগ্রিক নিরাপত্তা আজ কেবল আর ভূমিপ্রশ্ন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও নানামাত্রিক সম্পর্ক। আশা করব, রাষ্ট্র এ বিষয়ে সজাগ ও তৎপর হবে। পানপুঞ্জির জীবন–জীবিকা ও পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ নীতি, বাজেট ও পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। কারণ, তা না হলে দিন দিন বিরোধ ও দ্বন্দ্ব বাড়বে, তৈরি হবে সংঘাত এবং দেখা যাবে দেশের কিছু নিপীড়িত মানুষ বারবার উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্গ সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু যখন কাঁকড়াছড়া, আগার বা বনাখলা পানপুঞ্জির মানুষের হাহাকারের গল্প শুনি, তখন আমাদের মন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। প্রমাণিত হয় পানপুঞ্জিগুলোয় এখনো ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি। সাম্প্রতিক পরিদর্শনে আমরা বৈরাগীপুঞ্জি, শীতলাপুঞ্জি, জোলেখাপুঞ্জি, নার্সারিপুঞ্জি, ফুলতলাপুঞ্জির নাম শুনেছি। এসব পুঞ্জি জবরদখল হয়েছে এবং সেখানে এখন দখলদার বাঙালিরাই বসবাস করছে।

বৃহত্তর সংহতি ও স্থায়ী সমাধান
সাম্প্রতিক মৌলভীবাজার সফরে আমরা দারুণভাবে সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত পানপুঞ্জির পাশে আমরা অগণিত মানুষকে দাঁড়াতে দেখেছি। হাতে গোনা কিছু জবরদখলকারী ও দুর্বৃত্ত এই জনশক্তির কাছে অতি নগণ্য। মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার তৎক্ষণাৎ কাঁকড়াপুঞ্জির সমস্যা নিয়ে যোগাযোগ করেছেন এবং পুঞ্জির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আশ্বাস দিয়েছেন। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক জোর দিয়ে বলেছেন, পুঞ্জিবাসীর জীবন–জীবিকার সুরক্ষাই তাঁর প্রথম অগ্রাধিকার। আমরা প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের এসব আশ্বাসে শতভাগ আস্থা রাখতে চাই। আমরা দেখতে চাই, রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে পানপুঞ্জির ভূমি সংকটের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করেছে। পানপুঞ্জির ভূমিপ্রশ্নকে জাতীয় সংসদে যথাযথভাবে উত্থাপনের জন্য জনপ্রতিনিধিদের কাছে আমরা প্রস্তাব রাখছি। চা–বাগান কর্তৃপক্ষ, চা বোর্ড, ভূমি মন্ত্রণালয়, বন বিভাগ, আদিবাসী সংগঠন, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ—সবার মতামত ও পরামর্শেই এ সংকটের গ্রহণযোগ্য সমাধান সম্ভব।

আমরা স্বপ্ন দেখি কাঁকড়াছড়া, আগার ও বনাখলা পানপুঞ্জির শিশুরা বড় হবে এক নিরাপদ বৈষম্যহীন পরিবেশে। আসুন আমরা দৃষ্টিভঙ্গি, কাঠামো, নীতি ও পরিকল্পনায় এভাবেই নিজেদের প্রস্তুত করে তুলি আর দাবি তুলি:
১. পানপুঞ্জি জবরদখল, গাছ কাটা ও পানজুম ধ্বংসের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
২. ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সুনির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩. পানপুঞ্জির নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ মৌলিক নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৪. পানপুঞ্জির নাগরিকদের জীবন ও জীবিকার সামগ্রিক নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।
৫. পানপুঞ্জির জায়গাগুলো চা–বাগান থেকে ইজারা বন্দোবস্ত বাতিল করে পুঞ্জিবাসীর জন্য বন্দোবস্ত দিতে হবে।
৬. চা–বাগান সম্প্রসারণের নামে কোনো পানপুঞ্জির গাছ কাটা যাবে না এবং পুঞ্জির জায়গা ও পানজুম দখল করা যাবে না।
৭. মৌলভীবাজার অঞ্চলের খাসি, মান্দিসহ চা–বাগানের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশে ‘আদিবাসী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’ তৈরি করতে হবে।


লেখকেরা শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, পরিবেশকর্মী, গবেষক, আদিবাসী সংগঠক, সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী।