দশম সংসদের কাছে সবিনয় নিবেদন
বহুল আলোচিত দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন ২৯ জানুয়ারি শুরু হয়েছে। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদেরা নির্বাচিত হয়েছেন। তাই দেশের প্রায় অর্ধেক অংশের ভোটার ভোটদানের কোনো সুযোগই পাননি। বাকি আসনগুলোতে ব্যতিক্রম কয়েকটি আসন ব্যতীত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী ফলাফল একপ্রকার পূর্বনির্ধারিতই ছিল। তাই বর্তমান সংসদের চেহারা কেমন হবে, সেটি নিয়ে আর জল্পনা-কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়নি। তবে মন্ত্রিপরিষদ গঠন নিয়ে কম-বেশি একটু কৌতূহল তো ছিলই।
নির্বাচন বাতিল ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের দেশব্যাপী টানা অবরোধ-হরতাল, একই সঙ্গে হামলা-সহিংসতার ঘটনা আমাদের কারোর অজানা নয়। এসব সহিংসতায় দেশের অনেক সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। মোট কথা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এ হিসাবের বাইরে রাখলে, নিরীহ সাধারণ পথচারী থেকে শুরু করে নারী, শিশু, শ্রমিক, চাকরিজীবী, বাসযাত্রী কোনো শ্রেণীই এ বর্বর হামলা থেকে বাদ পড়েননি।
কিন্তু যত আলোচিত-সমালোচিতই হোক না কেন, নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। একতরফা নির্বাচন হলেও নির্বাচন-পরবর্তী অনিবার্য (!) সহিংসতার হাত থেকে সংখ্যালঘুরাও মুক্তি পাননি। নির্বাচনের আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, প্রতিমা, ঘরবাড়িতে নির্বিচারে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাট চালানো হলেও সরকার এ বর্বর হামলা বন্ধ করতে পারেনি।
হোক না নিরুত্তাপ নির্বাচনী হাওয়া, তবু প্রশাসনের অতি ব্যস্ততার অজুহাতে আক্রান্ত সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি আক্রান্ত মানুষ যখন প্রশাসনসহ রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্য চেয়েছিল, তখনো তাদের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের। নির্বাচন শেষ হয়েছে তিন সপ্তাহ। কিন্তু দেশে এখানে-ওখানে প্রতিমা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাহলে কি সাম্প্রদায়িকতার অনল এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর তুষের আগুনের মতোই জ্বলতে থাকবে?
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে সহিংসতা বেড়ে গেলেও এবার ব্যতিক্রম ছিল তিন পার্বত্য জেলার নির্বাচনী পরিবেশ। নবম সংসদে মহাজোটের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের মানুষজনের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি পরিবর্তনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যার পরিণতিতে দেখা যায়, রাঙামাটি আসনে সরকারদলীয় প্রতিমন্ত্রীকে হারিয়ে জনসংহতি সমিতির সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয়। অন্যদিকে খাগড়াছড়ি আসনেও ইউপিডিএফ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে সরকারদলীয় প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই থেকে এটি স্পষ্ট যে পাহাড়ের মানুষ পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
খাগড়াছড়ি আসনে ভোটের চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, আটটি উপজেলার মধ্যে পাঁচটি উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী এগিয়ে ছিলেন। ইউপিডিএফ নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছে, মাটিরাঙ্গা, রামগড় উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে ব্যাপক জালিয়াতি করা হয়েছে এবং বিজয়ী-বিজিত প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান এ উপজেলাগুলোতেই করা হয়েছে। ইউপিডিএফের এ অভিযোগে যদি সত্যতা থাকে, তাহলে খাগড়াছড়ি আসনটিতেও ক্ষমতাসীনদের চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না করার খেসারত গুনতে হতো!
এ ছাড়া ভোট গ্রহণের দিন সারা দেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকলেও তিন পার্বত্য জেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তিন পার্বত্য জেলায় নিরাপত্তার অজুহাতে এ বৈষম্যমূলক প্রশাসনিক পদক্ষেপের পেছনে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার গভীর ষড়যন্ত্র ছিল বলে অনেকে মনে করেন।
নবম সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করেনি। পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহ সংসদে উত্থাপিত হলেও তা অধিকতর মূল্যায়নের কথা বলে সংসদে পাস করা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান পদটি শূন্য রেখে কমিশনকে মূলত অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দাবিদার হলেও মহাজোট সরকারের আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বারবার সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এ বিষয়গুলো পাহাড়ের মানুষজনের মনে গভীর হতাশা তৈরি করেছিল। আর এ হতাশাই নির্বাচনের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।
কাজেই চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষ হিসেবে বর্তমান সরকারকেই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নসহ পাহাড়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। একইভাবে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অসাম্প্রদায়িক, নিরপেক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি নিরাপত্তার অজুহাতে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি না করে পাহাড়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের পরিবেশ গড়ে তোলা আবশ্যক। উল্লেখ্য, এবারের নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে পাহাড়ি-বাঙালির সম্প্রীতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, যেটি পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক একটি দিক।
সবশেষে বলতে চাই, যেহেতু বর্তমান সংসদের ওপর শুরু থেকে দেশের জনগণের একটা অবিশ্বাসের ছায়া রয়ে গেছে, তাই এখন সরকারকেই ভালো কাজের সূচনা দিয়ে জনমনের এ সন্দেহ দূর করতে হবে। নির্বাচনকালীন সহিংসতার আগুন এখনো নেভেনি। নতুন বছরে কচিমনের শিশুরা নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিয়ে নতুন ক্লাসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাজার হাজার শিশু এখনো খোলা আকাশের নিচে বসে লেখাপড়ার জন্য আকুতি জানাচ্ছে, সংখ্যালঘু পরিবারের ভীতসন্ত্রন্ত মুখগুলো এখনো জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল খুঁজে ফিরছে। তাই নতুন সংসদের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে, বিগত সময়ে পাহাড় ও সমতলের মানুষের কাছে যে আস্থা হারিয়ে গিয়েছিল সে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকেই আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com