Thank you for trying Sticky AMP!!

মনীষী ও সমাজসংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

দয়ারসাগরের কদর হয়েছে, আধুনিক বিদ্যাসাগরের হয়নি

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সময়ের চেয়ে অগ্রসর, একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন। কেমন আধুনিক? উত্তর দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ: ‘যে গঙ্গা মরে গেছে তার মধ্যে স্রোত নেই, কিন্তু ডোবা আছে। বহমান গঙ্গা তার থেকে সরে এসেছে। সমুদ্রের দিকে তার যোগ। এই গঙ্গাকেই বলি আধুনিক। বহমান কালগঙ্গার সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের জীবনধারার মিলন ছিল, এই জন্য বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক।’


বিদ্যাসাগরের এই আধুনিকতার যথার্থ মূল্যায়ন তাঁর সময়ে হয়নি, তাঁর জন্মের ২০০ বছর পর আজও হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো এ যুগের মানুষও তাঁকে দয়ারসাগর, করুণাসাগর হিসেবে চেনে, দামোদর নদী-সন্তরণের কাল্পনিক কাহিনির নায়কের মাতৃভক্তিতে আপ্লুত হয়। কিন্তু যে ‘অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মানবতার’ জন্য তিনি পর্বতের মতো মাথা তুলে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন; তার স্বরূপ তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্যের কাহিনির নিচে চাপা পড়ে গেছে।

বিদ্যাসাগরের আগে ও পরে অনেকেই ইংরেজি শিখেছিলেন। তবে বিদ্যাসাগর ইংরেজি শিখেছিলেন অন্যদের তুলনায় বেশি বয়সে, নিজ উদ্যোগে, ইংরেজিশিক্ষিত নানা ব্যক্তির কাছে। ইংরেজি শিখে অনেকেই পোশাক-আশাকে, চলন-বলনে, খাবার-দাবারে ইউরোপীয় হয়েছিলেন বটে কিন্তু মনের ভেতরে অনাধুনিক রয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের গায়ে পশ্চিমের হাওয়া লেগেছিল, হৃদয়ে ইউরোপীয় মুক্তচিন্তা, মানবমুখিনতার আলো পৌঁছায়নি। বিদ্যাসাগর ছিলেন ঠিক উল্টো। তিনি বাইরে ছিলেন বাঙালি ব্রাহ্মণ, কিন্তু মনের ভেতর ইউরোপীয় আধুনিকতাকে ধারণ করেছিলেন।

এই আধুনিকতাই বিদ্যাসাগরকে সব ধরনের ভাববাদী চিন্তা থেকে মুক্ত করে মানবমুখিন, পার্থিব করে তুলেছিল। তিনি সমাজ থেকে সব ধরনের কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতা দূর করতে ব্রতী হয়েছিলেন।

২.
বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক অনেকেই বালিকা-বিধবাদের কষ্টে কাতর হয়েছেন, বিধবাবিবাহের পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর ‘বিধবাবিবাহ আইন’ পাস করানোয় নিয়ামক ভূমিকাই পালন করেননি শুধু বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য ধন-প্রাণ-মন সঁপে দিয়েছিলেন। নিজ উদ্যোগে, নিজ দায়িত্বে ও নিজ ব্যয়ে অনেকগুলো বিধবা বিয়ে দিয়ে, হিন্দুসমাজে তিনি বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেন। এ জন্য তাঁর জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে, তিনি পরোয়া করেননি।

বাংলায় নারী-শিক্ষার উদ্যোগও বিদ্যাসাগরের পূর্বেই শুরু হয়েছিল। এমনকি কিছু রক্ষণশীল শিক্ষিত হিন্দু নারীও শিক্ষার সমর্থনে লেখালেখি করেছিলেন। কিন্তু নারী শিক্ষা প্রচলন বিদ্যাসাগরের ব্রত ছিল। স্কুল ইন্সপেক্টর থাকার সময় ছোটলাট হ্যালিডের মৌখিক প্রস্তাবেই যখন তিনি আগ্রহী হয়ে বাংলায় শতাধিক মেয়েকে নিয়ে স্কুল খুলে ফেলেন, তখন বুঝতে পারা যায় নারীশিক্ষা প্রচলনে তাঁর ব্যগ্রতা কতটুকু ছিল। পরে এই স্কুলের ব্যয় বহন করতে ব্রিটিশ সরকার অস্বীকার করলে তিনি নিজের অর্থে স্কুলের সব শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করেন।

বিদ্যাসাগর প্রচলিত অর্থে সাহিত্যচর্চা করেননি। তিনি সময়ের ও শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন। পাঠ্যপুস্তক লিখতে গিয়েই তিনি সাহিত্যিক বাংলা ভাষা নির্মাণ করেছেন এবং আধুনিক যুগে আধুনিক বাংলা ভাষার ‘প্রথম যথার্থ শিল্পী’ হয়েছেন। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে ‘পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা’ বলে অবজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজ সিভিলিয়ানদের জন্য লেখা তাঁর ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ বাংলা ভাষায় প্রথম গল্পের বই হিসেবে ঘরে ঘরে পঠিত হয়েছে। বাঙালি শকুন্তলার কাহিনি কালিদাসের নাটক থেকে জানেনি, জেনেছে বিদ্যাসাগরের ‘শকুন্তলা’ পড়ে। শিশুদের জন্য লেখা পাঠ্যবইকে তিনি সব অপার্থিবতামুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন।

রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগর স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বিচার করতেন না। জাতিধর্ম-নির্বিশেষে তিনি নিজ হাতে চেনা-অচেনা কলেরা, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগীর সেবা করেছেন। তাঁর ওপর বর্ণাশ্রম প্রথারও প্রভাব ছিল না। সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য কোনো বর্ণের হিন্দুর পড়ার অধিকার ছিল না। তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার পর তাঁর সমর্থন ও উদ্যোগে কলেজের দ্বার অন্যান্য বর্ণের হিন্দু ছাত্রদের জন্যও উন্মুক্ত হয়। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষার্থীদের তিনি পর্যাপ্ত ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে সক্ষম করে তুলতে চেয়েছেন। ভাববাদিতার হাত থেকে মুক্ত করে তাঁদের মধ্যে যুক্তিবাদিতার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন।

অন্যের কাছ থেকে ঋণ করে তিনি কেবল মাইকেল মধুসূদন দত্তকেই টাকা ধার দেননি, আরও অনেককেই দিয়েছেন। ফেরত পাওয়ার আশা নেই জেনেও দিয়েছেন। তিনি কারও দান গ্রহণ করতেন না কিন্তু নিজে অকাতরে দান করেছেন। তাঁর কাছে প্রতি মাসে মাসোহারা পেতেন প্রচুর দুস্থ মানুষ। তবে তাঁর এসব দান-ধ্যানের প্রেরণা কোনো পারলৌকিক লাভের আশা থেকে আসেনি, এসেছে তাঁর মানবপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে।

অক্ষয়কুমার দত্তের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরিচয় তৎকালীন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। সমাজজীবনে এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুক্তচিন্তা এবং বিজ্ঞানমনস্কতা প্রবর্তনের জন্য এই দুই বন্ধুর প্রচেষ্টা অবিস্মরণীয়। এ বছর অক্ষয় দত্তেরও জন্মের ২০০ বছর হলো।


পরাধীন ভারতে বিদ্যাসাগর যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল। এই আন্দোলনের সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের কোনো সংস্রব ছিল না, সংস্রব ছিল না হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণের মানুষেরও। ঐতিহাসিক কারণে মুসলিম সমাজও এসব কর্মকাণ্ডের অংশীদার ছিল না, বিধবাবিবাহ আন্দোলন তাঁদের জন্য প্রাসঙ্গিকও ছিল না। কিন্তু তাই বলে পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের কাজের সুফল যে নিম্নবর্ণের মানুষ বা মুসলমানরা ভোগ করেননি বা বিদ্যাসাগর দ্বারা অনুপ্রাণিত হননি, তা নয়। বিদ্যাসাগর যে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছিলেন, বাঙালি মুসলিম সমাজকে তার অংশীদার করাই ছিল বেগম রোকেয়ার ব্রত। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’ স্লোগান নিয়ে যাঁরা বাঙালি মুসলিম সমাজে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর নিশ্চয়ই তাঁদের প্রেরণার উৎস ছিলেন।

যেসব আর্থসামাজিক বিকাশের প্রেক্ষাপটে ইউরোপে চিন্তায় মননে পার্থিবতা ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটেছিল, ঔপনিবেশিক ভারতে তা অনুপস্থিত ছিল। এ কারণে বিদ্যাসাগরের আধুনিকতাকে তৎকালীন বঙ্গসমাজ ধারণ করতে পারেনি। বিদ্যাসাগরের দয়া-দাক্ষিণ্য, মাতৃভক্তি সেই সমাজের মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল বলেই করুণাসাগর বিদ্যাসাগরের কদর হয়েছে, আধুনিক বিদ্যাসাগরের হয়নি। বিবিধ কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দশকগুলোতে বাংলার হিন্দুসমাজ পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কারের পুনর্জাগরণের উর্বরভূমি হয়ে উঠেছিল। ‘ঋষি’ বঙ্কিম ও বিবেকানন্দ ‘স্বামী’ সেই উর্বর ভূমিতে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত ফসল ফলিয়েছেন।

চিন্তা-চেতনায় ক্রমাগত পশ্চাদপসরণ করে আমরাও আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, তাতে মনে হয় বিদ্যাসাগর শুধু তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন না, আমাদের সময় থেকেও এগিয়ে আছেন। তাই আজ তাঁর দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতেও বিদ্যাসাগর আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক, বিদ্যাসাগর চর্চা এখনো জরুরি।


চৌধুরি মুফাদ আহমদ: প্রাবন্ধিক
cmahmed@gmail.com