ধর্ষণ ও যৌন সন্ত্রাসের কারণ ক্ষমতালিপ্সা
আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের গান গাই—/আমার চক্ষে পুরুষ–রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!’ কিন্তু লিঙ্গ কিংবা জেন্ডারভিত্তিক সাম্য-দুনিয়া আমরা পেলাম কি আদৌ? বৈষম্য আর সহিংসতা থেকে নারী আসলে কতটুকু মুক্তি পেল? এই তো সেদিন, চলমান করোনাকালে সারা বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণে জাতিসংঘ এই সমস্যাটিকে কোভিড-১৯-এর ছায়া–মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর বাংলাদেশ? বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ বলছে, শুধু এপ্রিল মাসে লকডাউন চলাকালে দেশের ২৭টি জেলায় ৪ হাজার ২৪৯ জন নারী নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ১ হাজার ৬৭২ জন নারীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা প্রথম। ৮৪৮ জন নারী তাঁর স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত। এর বাইরেও ধর্ষণ, নারী হত্যা, যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা তো রয়েছেই। এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ৩১ শতাংশ।
মার্কিন সাংবাদিক ও নারীবাদী সুসান ব্রাউন মিলার তাঁর এগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, ওমেন অ্যান্ড রেপ (১৯৭৫) বইয়ে লিখেছেন ধর্ষণ হচ্ছে নারীকে ভয় ও আতঙ্কের আবহের মধ্যে রাখায় পুরুষের এক সচেতন প্রচেষ্টা। কোনো এক পিশাচ হঠাৎ এসে যৌনতার সন্ত্রাস প্রদর্শন করবে শরীরকে বিস্তৃত করে, এই আতঙ্ক নারীকে আরও পিছিয়ে দেয় পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
অপরাধবিজ্ঞান কী বলে? কেনই বা ঘটছে এসব? এই সব সহিংসতার বিস্তারই বা আসলে কতদূর?
অপরাধবিজ্ঞানের জায়গা থেকে প্রথম যেটি নিয়ে আলোচনায় আশা যেতে পারে তা হলো, ‘টক্সিক মাসকুলিনিটি’। পৌরুষত্বের নামে যে ভ্রান্ত ধারণাগুলো পুরুষকে মানব থেকে দানবে পরিণত করে, মূলত তাই–ই হলো এই ‘বিষাক্ত ব্যাটাগিরি’। পুরুষকে আগ্রাসী আর কর্তৃত্বপরায়ণ হতে হবে, হিরো হতে হলে অনেক বেশি যৌনতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে কিংবা উচ্চতর লিঙ্গ হিসেবে অন্য লিঙ্গকে সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে—এগুলোই পুরুষকে ধর্ষণের মতো অপরাধের দিকে ধাবিত করে, যেখানে ‘সম্মতি’ নামক শব্দটি তাদের মনোজগৎ থেকে হারিয়ে যায়।
বিশ্ববিখ্যাত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টে নিকোলাস গ্রোথ ১৯৭৭ সালে মার্কিন জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিতে ধর্ষণের পেছনের কারণগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করেন। প্রবন্ধের শুরুতে তিনি বলেন, ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্রোধ ও যৌনতা বেশির ভাগ ধর্ষণের মূল কারণ। এখানে ১৩৩ জন অপরাধী ও ধর্ষণের শিকার ৯২ জনের ওপর সমীক্ষায় দেখা যায়, তারা কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব থেকে ধর্ষণ করেছে। এবার আরও গভীরে গিয়ে দেখা যায় প্রফেসর শেরি হ্যাম্বি বলেছেন, ধর্ষক যৌন সুখের জন্য নয়, বরং পৌরুষত্ব প্রমাণের জন্য ধর্ষণ করে। এ ছাড়া যখনই নারী ধর্ষণে সম্মতি না দেন, অনেকেই সেটাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নেয় এবং প্রতিশোধ হিসেবে ধর্ষণ করে। বিভিন্ন গবেষণা খুঁজলে এ রকম অনেক কারণই হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু এই কারণগুলোর পেছনেও রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছু রাজনৈতিক অর্থনীতির খেলা।
ক্ষমতা প্রকাশের জায়গা থেকে ধর্ষণ করাটা মূলত রাজনৈতিক, কারণ এটা নারীকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল প্রতিপক্ষ বানিয়ে রাখার অস্ত্র। আর পুরুষের মতো বের হওয়ার স্বাধীনতা ভোগ করতে না দেওয়াটা একদম অর্থনৈতিক। যত বেশি নারী পুরুষের মতো বাইরে থাকবেন, তত তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন। এর মাধ্যমে সমকক্ষতা অর্জন করবেন। তা ক্ষমতাবান পুরুষ চাইবে কেন? কিন্তু নারী তো পুরুষের বাধ্যতা গ্রাহ্য করছেন না। বের হতে চান নারী। আর পিছিয়ে থাকতে চান না। তখনই বলপ্রয়োগের জুজু ব্যবহার করা হয়, কখনো ইভ টিজিং, কখনো অ্যাসিড, কখনো হয়রানি, কখনো ধর্ষণ। ব্যাপারটাকে আলগাভাবে পুরুষের শারীরিক চাহিদা মনে করা হয়। কিন্তু এটা আসলে পুরুষের না, পুরুষতান্ত্রিকতার চাহিদা। এটা যত না দুই পায়ের মাঝখানের দণ্ডের চাহিদা, তার চেয়ে অনেক বেশি চাহিদা ক্ষমতার দণ্ডের। পুরুষ আসলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দাপট নারীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে নারাজ। কিন্তু দক্ষতা আর যোগ্যতায় যখন সে পেরে ওঠে না তখন সে নারীকে থামাতে চায়। এই থামানোর অনেক অস্ত্রের মধ্যে ধর্ষণ সবচেয়ে জঘন্য এবং শক্তিশালী। কারণ নারীর সব অহংকার এই সমাজ তার যোনিপথের সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছে। তাই যেকোনো রাজনৈতিক যুদ্ধে নারীদের ধর্ষণ করা মানে হলো তার পরিবার, তার স্বজন পুরুষ সবাইকে একসঙ্গে মানসিকভাবে পরাজিত করা। এখন যুদ্ধ নেই কিন্তু সেই মানসিকতা রয়ে গেছে অনেক পুরুষের অন্তরে।
একজন নারীকে ধর্ষণের সামাজিক প্রভাব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু সেটার অর্থনৈতিক ‘ক্ষতি’ নিয়ে আলাপ হয় না কেন? ধর্ষণের শিকার একজন নারী অর্থনৈতিকভাবে কতদূর পিছিয়ে যান, তা কি ভাবি আমরা? ভাবি তো না–ই বরং এলাকায় রেপের ক্ষতিপূরণ ধরা হয় ১০ হাজার টাকা! অথবা ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে! তো, কেন এই আপসনামার নামে নারীকে আরও দলিত করা? কারণ আমাদের সমাজ ভাবে, ধর্ষণ করার মাধ্যমে একজন নারীর সম্ভ্রম বা সম্মানকে হরণ করা সম্ভব। দার্শনিক মিশেল ফুকোর কথা তাই টানতেই হয়। তিনি বলেছেন, ধর্ষণকে যৌনতা থেকে আলাদা করে একটি ভায়োলেন্ট অপরাধ হিসেবে দেখতে হবে। এটি করতে পারলে আমরাও ধর্ষণকে সম্মানহানি ভাবা থেকে বিরত থাকব বলে আশা করা যায়।
সমাধানটি কী বা কোথায় সেটা নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন। সমাধান এক দিনে বা এক বছরে সম্ভব নয়, কয়েকজনকে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড দিলেও না। অনেকের কাছে এটি হতাশাব্যঞ্জক কথা মনে হলেও আমি এর কারণ ব্যাখ্যা করছি। অন্য অপরাধের সঙ্গে ধর্ষণের পার্থক্য হলো, এর পেছনে একটি নয়, একাধিক মাত্রার কারণ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ধর্ষকের মনস্তত্বকে প্রভাবিত করে, সেখানে অপরাধের শাস্তিতে গুরুত্ব আনার অনেক আগে ‘দূষিত ব্যাটাগিরি’, যৌনবস্তু হিসেবে নারীকে দেখা, রাজনৈতিক শক্তি ও অর্থের অপপ্রয়োগে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নারীকে অপমানিত করতে সাহস দেয়, ধর্ষণ করতে দুঃসাহস দেয়। তাই ১৮৬০ সালের ‘পেনাল কোড’–এর সমস্যাযুক্ত ‘ধর্ষণ’–এর সংজ্ঞা কেন ২০০০ সালের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’–এ বলবৎ রাখা হলো, কেন ২০১১–এ খসড়া করা ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ এখনো আলোর মুখ দেখল না, কেন ২০০০ সালের আইনে ‘ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা আহত হলে’ সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ফাঁসি রাখা হলেও ধর্ষণ কমছে না?
এসবের অনেক আগে আমাকে ভাবতে হবে, পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই নারী–পুরুষ সমতা নিয়ে আমাদের কী শিক্ষা দেয়? যত দিন পরিবারে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শুধু বাবা হবেন, ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুর প্রতি আচরণে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য হবে, স্কুলগুলো সেক্স এডুকেশন পড়ানো থেকে বিরত থাকবে, গণমাধ্যম সোচ্চার না হবে, তত দিন নারীর প্রতি সহিংস আচরণ কমবে না। তাই আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ বাড়ি থেকে পরিবর্তন আনতে হবে। নিজের বাবা, স্বামী আর ভাইকে প্রশ্ন করতে হবে তাঁদের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য। আর আমরা নারীরা? নর থেকে ‘নারী’, মহলে থাকেন বলে ‘মহিলা’ আর রমণ করা যায় বলে ‘রমণী’ হয়ে যত দিন থাকব, তত দিন স্বাধীনতার স্বাদ আমরা পাব না। যেদিন ‘মানুষ’ হতে পারব নিজেদের ও সমাজের চোখে, সেদিন আর রাত জেগে এই রকম লেখা আর লিখতে হবে না।
উম্মে ওয়ারা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
আরও পড়ুন
-
সকাল ৯টার ট্রেন ছাড়েনি বেলা ২টায়ও, স্টেশনেই ঘুমিয়ে পড়েছেন ক্লান্ত মা-মেয়ে
-
পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল ভারত
-
সঠিক তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন করলে পূর্ণ সহায়তা দেওয়া হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
-
ঝড়বৃষ্টি হতে পারে ৬ দিন ধরে, বলছে আবহাওয়া অফিস
-
ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা