Thank you for trying Sticky AMP!!

ধর্ষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদে চোখে কালো কাপড় বেঁধে মানববন্ধন আয়োজন করে দুটি সামাজিক সংগঠন। সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে, ৬ অক্টোবর।

ধর্ষণ বিষয়ে যে দুটি বয়ান ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে

সামাজিক মাধ্যমে একটি আলোচনা জোরদার হচ্ছে যে আমেরিকাসহ বহু উন্নত দেশেই ধর্ষণকাণ্ড বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। অন্যদিকে সাম্প্রতিক ধর্ষণের অপরাধগুলোর প্রতিক্রিয়ায় ফাঁসি, ক্রসফায়ার এবং পুরুষাঙ্গ কর্তনের দাবি বেশ জোরেশোরেই মুখ মুখ হয়ে অনেকের কলমেও উঠে আসছে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং আইনজীবীদের কাউকে কাউকে এসব লোকপ্রিয় ভাষ্য প্রকাশ করতে দেখছি। এসব বয়ান সাময়িক ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া বা ঘৃণা প্রকাশ হিসেবে একেবারে অস্বাভাবিক কিছু হয়তো নয়। তবে টেকসই সমাধানের পথে বাধা অবশ্যই। ‘ঘরপোড়ার মধ্যে আলুপোড়া’ লোকপ্রবাদটি মনে রাখা দরকার। সুযোগ বুঝে মুখ খুলছেন নারীর পরিধান পোশাকে সমস্যা খুঁজে পাওয়া মানুষেরাও। ‘নারীও কম দায়ী নয়’ বয়ানও পিছিয়ে থাকছে না। ধর্মশিক্ষা ও নৈতিকতাপন্থীরাও নিজ নিজ ভাষ্য প্রকাশ-প্রচারের সুযোগ নিচ্ছেন।

নানান মত-পথ, ভিন্ন-ভিন্নজনের ভিন্ন-ভিন্ন বুঝবাঝ জানার দরকার আছে। তা না হলে সামাজিক আন্দোলন সঠিক রাস্তাটি পাবে না। এমসি কলেজ এবং বেগমগঞ্জের ঘটনার পর ‘ধর্ষণ’ এখন আলোচনার কেন্দ্রে। আলোচনা প্রয়োজনও বটে। স্বাভাবিকভাবেই নারীবাদমনস্ক এবং নারীবাদবিরোধী মানুষেরাও মাঠে থাকছেন। একটি সামাজিক আন্দোলন সংগঠনের সূচনাদৃশ্যও রচিত হয়েছে শাহবাগ, প্রেসক্লাব এবং দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে। মানববন্ধন এবং সমাবেশগুলোতে সমাগম বাড়ছে। তবে সূচনাতেই যা বললাম, গণভাবনায় ধর্ষণ সমস্যার মাত্রা-ধরন এবং কারণ নিয়ে নানা রকম নতুন নতুন বিভ্রান্তি চালাচালি চলছে। বিভ্রান্তি সমস্যাটি সমাধানের পরামর্শের বেলায়ও। যেমন ফাঁসি-ক্রসফায়ার-অঙ্গচ্ছেদ দাবিগুলো।

বিভ্রান্তিগুলোর কিছু কিছু নিতান্তই মতলবি, কিছু কিছু তত্ত্বগত। কিন্তু সেগুলোকে ধরতে না পারলে কাটা শামুকে আরও বেশি বেশি পা কাটবে। পত্রিকায় এই আলোচনা করার পরিসরটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র। সে জন্য শুধু কয়েকটি মারাত্মক বিভ্রান্ত-বয়ান উল্লেখ করছি। সমাজ বদলেছে, বদলাচ্ছে এবং আরও বদলাবে। তাই অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে মাথায় রেখেই সমাধানের চিন্তা বের করতে হবে। সমাধানের ঠিক ঠিকানা খুঁজে বের করতে হলে কতগুলো বিভ্রান্তি কাটানো প্রয়োজন।

এক. কোথায় বা কোন দেশে ধর্ষণ নেই

সামাজিক মাধ্যমে অনেকে লিখছেন এবং শেয়ার করছেন, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৩-১৪টি ধর্ষণের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন হাজারখানেক যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। প্রতি দেড় মিনিটে, কোনো কোনো তথ্যমতে প্রতি ছয় মিনিটে একটি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। প্রতি ছয়জন নারীর একজন তাদের জীবদ্দশায় একবারের জন্য হলেও ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণে শিকার নারীদের এক-তৃতীয়াংশই আত্মহত্যার চেষ্টা করে ইত্যাদি।

পরিসংখ্যানকে আমলে নিলে মনে হবে, ‘তাই তো! আমরা তো দারুণ ভালো অবস্থায়ই আছি!’ মার্ক টোয়েন, মতান্তরে ডিজরেইলির উক্তিটি মনে রাখা দরকার, ‘মিথ্যা তিন প্রকার—মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান।’

সমাজ-বাস্তবতা না জেনে পরিসংখ্যান তুলে তুলনা টানা বোকামি। যুক্তরাষ্ট্রে যৌন নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ দায়ের হয় ৯৫ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশে ৫ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশে লোকভয়, পরিবারের জন্য ভয়, মান-সম্মানবোধ, অপমান-অপবাদ বিয়ে-শাদি না হবে না ভেবে সিংহভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার নারীই ঘটনা লুকিয়ে রাখেন। পুলিশকে ভরসা দূরে থাকুক, পুলিশের কাছে বিচার দিতে গিয়ে পুনরায় নির্যাতিত হওয়ার বা যৌন নিপীড়নের আশঙ্কায় থানামুখী হন না লাখো নির্যাতিতা। বেগমগঞ্জের নৃশংস ঘটনাটি জানতেই যেখানে ৩২ দিন লাগল, অনুমেয়, একেবারেই লোকচক্ষুর আড়ালে প্রমাণহীন প্রতিদিনের হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনার দুর্বহ ট্রমা একান্তে গোপন রেখেই লাখ লাখ নারী-তরুণী-কিশোরীকে পুরো জীবন কাটিয়ে যেতে হয়।

পুলিশ অভিযোগের কয়টি নেয়? থানাকে ‘মডেল থানা’ দেখানোর জন্য, তাদের থানায় অপরাধ কম ঘটছে দেখানোর জন্য থানাগুলো ৫-৬ শতাংশের বেশি অভিযোগ আমলেই নেয় না। যা না নিলেই নয়, শুধু সেগুলোই নেয়। যুক্তরাষ্ট্রে থানা ১০০ শতাংশ অভিযোগ নিতে বাধ্য। কেউ কু-ইঙ্গিত করেছে, কুপ্রস্তাব দিয়েছে, চিমটি কেটেছে বা চোখ ঠার মেরেছে, এমন অভিযোগও অন্তর্ভুক্ত আছে মার্কিন পরিসংখ্যানের ‘যৌন নিপীড়ন’ তালিকায়। বাংলাদেশে প্রতিদিন ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটে কয়েক লাখ। এসবই ভুক্তভোগী আম-নারীর গা-সওয়া। তাঁরা ধরে নেন, এটিই নিয়তি। পুলিশকে বলা দূরে থাক, মা-বাবা-ভাই-বোনকেও বলা যায় না।

আসুন, সংজ্ঞার বেলায়। ছোঁয়া লাগে না, প্রস্তাব দেওয়া লাগে না, কুইঙ্গিতে তাকানোও যৌন নিপীড়ন। বৈধ পার্টনার যেমন স্বামী বা আইনসিদ্ধ ছেলেবন্ধুটিও যদি নারীটির অসম্মতির পর যৌনকর্মে জোরাজুরি, পীড়াপীড়ি করে, সেটিও যৌন নিপীড়ন নামে সংজ্ঞায়িত। অসম্মতির পরও যৌনাচরণ করলেই ধর্ষণ। মার্কিন সমাজে স্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্কের সংখ্যা কম বিধায় প্রত্যেক বয়ঃপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের যৌথ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থাকে। স্থানীয়ভাবে বিষয়টিকে বলা হয় ‘সিরিয়াল মনোগ্যামি’ বা একাদিক্রমে এক বিবাহ। অর্থাৎ, একজন-একজন করে অনেক সঙ্গীসঙ্গ ঘটে। ফলে সংজ্ঞাসিদ্ধ ধর্ষণের অভিজ্ঞতাও কম-বেশি সবারই থাকে। এসব বাস্তবতাকে যদি আমলে নেওয়া হয়, অর্থাৎ পরিসংখ্যানের জন্য মার্কিন মডেল গ্রহণ করা হয়, বাংলাদেশের যৌন নির্যাতন শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপীয় এবং উন্নত দেশগুলোর কয়েক গুণ ছাড়িয়ে যাবে। সহজ উদাহরণ, ভারতে প্রতি ২০ মিনিটে একটি ধর্ষণ হয়, যুক্তরাষ্ট্রে সেটি প্রতি ৭৫ মিনিটে। কিন্তু ভারত পৃথিবীর ধর্ষণপ্রবণ প্রথম চারটি দেশের একটি। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কুড়িরও পর। আর বাংলাদেশের বেলায় ঘণ্টা-মিনিটভিত্তিক তথ্য নথিভুক্তও নেই।

‘কোথায় বা কোন দেশে ধর্ষণ নেই’ একটি অতি পরিচিত বয়ান। আপাতদৃষ্টে কথা তো ঠিকই! তবে বয়ানটি বিপজ্জনক। এটি ধর্ষণ সমস্যার লঘূকরণ ঘটায়। ক্ষেত্রবিশেষে বয়ানটি ধর্ষকের ধর্ষণের পক্ষে পরোক্ষ সমর্থন এবং অনুমোদনের মতো শোনায়। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কোনো দায়িত্ব নিতেই রাজি নন, বোধটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা ছাড়া ধর্ষণ থেকে নিষ্কৃতি চাওয়া কেউই তো দাবি করছেন না, পৃথিবীর কোনো একটি দেশ ধর্ষণমুক্ত বা ধর্ষণ থেকে চিরমুক্তি সম্ভব। চাওয়া একটিই সুবিচার ও ন্যায়বিচার। ধর্ষণকে কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা। তাই দায়িত্ববান ব্যক্তিরা যখন ‘কোথায়, কোন দেশে ধর্ষণ নেই’ ভাষ্যের মাধ্যমে অপরাধটির লঘূকরণ ও যৌক্তিকীকরণ করে ফেলেন, তখন নৈতিক কারণেই প্রতিবাদ হওয়া দরকার।

দুই. প্রকাশ্যে ফাঁসি, ক্রসফায়ার, অঙ্গচ্ছেদ প্রভৃতি দরকার

এই লোকতুষ্টিমূলক অনুসিদ্ধান্ত বারোয়ারি আলোচনায় আনাও বিপজ্জনক। কারণ ধারণাটি সরাসরি ‘আইনের শাসনের’ বিরোধী; ন্যায়বিচার ও সুবিচারের পরিপন্থী এবং মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ‘প্রকাশ্য ফাঁসি’ ও ‘অঙ্গচ্ছেদ’ অর্থহীন দাবি। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মৌলিক মানবাধিকার সনদের ধারা-উপধারা মানতে বাধ্য। তাই নাগরিকদের এ রকম ভাবনা দুনিয়ার চোখে আমাদের হাস্যকর চিন্তায় দড় হাস্যকর নাগরিক পরিচিতি দেওয়ার বাইরে কোনো কাজে আসবে না। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি সত্যি সত্যিই ক্রসফায়ারকে উপায় ধরে নেয়, আবারও অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের রমরমা বাণিজ্য গড়ে উঠবে। এত দিন মাদক ও সন্ত্রাসের ছুতোয় কী কী ঘটেছে, আমরা কীভাবে এত সাততাড়াতাড়ি বিস্মৃত হয়ে গেলাম? ধর্ষণের সাজানো অজুহাতে নিরপরাধ মানুষকে হত্যায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে বলা কীভাবে সম্ভব? কীভাবেই বা আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলাকেই এবং প্রাতিষ্ঠানিক নীতি-নৈতিকতাকেই বিসর্জন দিতে বলতে পারি?

অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দুটি প্রধান ধারা প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক। আইনবহির্ভূত পদ্ধতিতে দুটির একটিরও প্রয়োগ সম্ভব নয়। এসব এলোপাতাড়ি দাবি মূল গলদকেই গৌণ করে তোলে। গলদটি আইনি ও বিচারিক কাঠামোগত। যেমন বাংলাদেশে গত এক দশকে ধর্ষণ মামলার সুরাহার হার মাত্র ৩.৪৫ ভাগ। শাস্তির হার মাত্র ০.৪৫ ভাগ। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাদীপক্ষের বড় অংশই মামলা চালাতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। ধর্ষকদের রাজনৈতিক পরিচয়, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতাদর্পিতার ভয়ে পিছিয়ে আসেন অনেক নির্যাতিতা। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের ক্ষমতাদর্পী বেপরোয়াপনার কমতি নেই। তাঁদের দল ক্ষমতায় থাকা মানেই ধর্ষণের মতো অপরাধেও অলিখিত দায়মুক্তি মিলবে। বড় ভাইয়েরা দেখবেন। ধর্ষণকে রাজনৈতিক প্রতিশোধের, ভীতিপ্রদর্শনের এবং ভিন্নমত দমনের কাজেও ব্যবহার করা হয়। সুবর্ণচরের, সিলেটের, বেগমগঞ্জের ঘটনাগুলো অসংখ্য উদাহরণের কয়েকটি মাত্র!

রাষ্ট্র পরিসরে নির্যাতিতাদের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা কোথায়? সেফ হোম ও পুনর্বাসনকেন্দ্র নেই। ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের অভাব। ধর্ষণের পরীক্ষাটি এবং নারীর নির্যাতিত হওয়া প্রমাণ করার প্রক্রিয়া এখনো অনাধুনিক এবং নারীর জন্য অসম্মানজনক। যৌন অপরাধবিষয়ক রাষ্ট্রীয় বিশেষজ্ঞের অভাব। বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পর্নোগ্রাফি ও যৌন অপরাধ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ও সুপ্রশিক্ষিত প্রয়োজনীয় পুলিশ স্কোয়াডের অভাব। নাগরিক সমাজ এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে যৌন অপরাধবিরোধী প্রকল্পের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। স্থানীয় এবং আঞ্চলিক সামাজিক আন্দোলনের অনুপস্থিতি প্রকট। রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌনাপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ বাজেটের প্রয়োজন। কিন্তু সেই ভাবনা এখনো ভাবা হয়নি। নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের ব্যবস্থাটিকে একান্তই অর্থনীতির চোখে দেখা হয় এবং সামাজিক যৌনস্বাস্থ্য-নিরাপত্তা পরিকল্পনা তার সঙ্গে সমন্বিত করা হয়নি। পাঠ্যসূচিতে সচেতনতামূলক পাঠ নেই। নারীর শরীরী প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণের ভাবনাও কখনো রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় আসেনি।

এই যে এতসব নেই-নেই, সেগুলোকে আছে-আছে করে তোলার উপায় কী? কাজটি রাষ্ট্রকেই করতে হবে। রাষ্ট্রে জন-অংশীদারত্বের গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাব প্রকট। সে জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে দেশের কেন্দ্র পর্যন্ত সক্রিয় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে অধিকার আদায় করে নেওয়া পর্যন্ত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং স্থানীয়ভাবে গণপ্রতিরোধের বিকল্প নেই।

হেলাল মহিউদ্দীন : নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ ।