Thank you for trying Sticky AMP!!

পোশাকশ্রমিকের বেঁচে থাকার সংগ্রাম

রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকদের সন্ধানে স্বজনেরা

গত তিন দশকে গড়ে ওঠা পোশাকশিল্পের পেছনের ইতিহাস আসলে কী? অবশ্য আমাদের দেশের অধিকাংশ মালিকেরা মনে করেন, তাঁদের বিশেষ কারিশমা আজ পোশাকশিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তাঁরা এই খাতে ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিক এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ সবার অবদানকে অস্বীকার করে নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার অন্যদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেন। এমনকি তাজরীন ও রানা প্লাজার মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরও তাঁদের প্রকৃত চরিত্র যখন বিশ্বব্যাপী উন্মোচিত হলো, তখনো তাঁদের অন্ধ অহমিকার কমতি দেখি না। প্রকৃতপক্ষে পোশাকশিল্পের বিকাশের পেছনে রয়েছে শ্রমিকের সস্তা শ্রম, ঘাম, রক্ত, লাশ, স্বজন হারানোর বেদনা, অসংখ্য মানুষের কান্না, আহাজারি। এর কোনোটিকেই আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আজ বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প একটি শক্তিশালী অবস্থান করে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছেন পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা। তাই ১৯৭৮-৭৯ সালে ৪০ হাজার ডলার আয় করলেও বর্তমানে ২০১২-১৩ (জুলাই-এপ্রিল) পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩০৭ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাজরীন ও রানা প্লাজার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান খুব বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে বড় বড় ক্রেতা হাউসগুলো বাংলাদেশ থেকে মুখ ফেরায়নি। শ্রমিকের সস্তা শ্রমে উৎপাদিত পোশাক উন্নত দেশগুলোতে চড়া দামে বিক্রি করে তারাও মুনাফার পাহাড় গড়ছে। আমাদের মুনাফালোভী মালিকদের পাশাপাশি বায়িং হাউসগুলো থেকে সময় ও চাহিদামতো শিপমেন্ট করার চাপ রানা প্লাজার হত্যাকাণ্ডের জন্য কম দায়ী নয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে হুমকি দিলেও সস্তা শ্রমের লোভে তারা তাদের ক্রয়াদেশ প্রায় ঠিক রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্র আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নাটক করেছে জিএসপি কোটা নিয়ে। তাদের জিএসপি কোটা বাতিলের বিষয়টি নিরাপদ কর্মস্থল ও শ্রমিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়; বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশি মালিক ও আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংস্থাগুলো—উভয়েই আজ বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অমানবিক জীবনযাপনের জন্য দায়ী। একটির পর একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে চলছে। এর পরও সরকার বা মালিকদের পক্ষ থেকে উল্লেখ করার মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
অন্যদিকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম মজুরিতে পোশাকশ্রমিকেরা তাঁদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন। সম্প্রতি ডব্লিউআরসি এক গবেষণায় দেখিয়েছে যে, ২০১২ সালেও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। অবস্থান ভালো হলেও শ্রমিকের মজুরি কমে গেছে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে চীনের মজুরি ১২৫ শতাংশ বেড়েছে। এখানে বাজার হারানো ও পাওয়ার ব্যাপারের সঙ্গে সস্তা শ্রম ও মজুরির ব্যাপারটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। আমাদের মালিকেরা কোনো ধরনের দর-কষাকষি ছাড়াই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে অর্ডার নেন এবং নিজেরা অধিক মুনাফা লাভ করার জন্য শ্রমিকের ওপর তীব্র শ্রমশোষণ চালান।
আশির দশকে গড়ে উঠলেও ১৯৯৪ সালে প্রথমবার পোশাকশিল্পে ন্যূনতম মজুরি ৯৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ১২ বছর পর অর্থাৎ ২০০৬ সালে শ্রমিকের প্রবল আন্দোলনের মুখে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিকদের পক্ষে ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা করার জোরালো দাবি উঠলেও মাত্র এক হাজার ৬৬২ টাকা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়, যা পোশাকশ্রমিক ও নেতারা প্রত্যাখ্যান করেন। তিন বছর পর আবার নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু দুই মজুরি বোর্ডের মাঝখানে কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও মালিক ও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক সংগঠন ও পোশাকশ্রমিকদের পক্ষ থেকে দুই মজুরি বোর্ডের মাঝখানে মহার্ঘ ভাতার দাবি জানিয়ে আসা হয়, যাতে পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বাজারদরের সঙ্গে কিছুটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। কিন্তু সে ব্যাপারে সরকার বা মালিকপক্ষ কোনো কর্ণপাত করেনি। ফলে ২০১০ সালে শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন।
শ্রমিক সংগঠনগুলো অর্থনীতিবিদ ও পুষ্টিবিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে এবং মালিকদের অবস্থান বিবেচনায় রেখে ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকার দাবি উত্থাপন করেছিল। শুধু মালিকদের অনুরোধ করা হয়, তাঁদের উগ্র বিলাসিতা বাদ দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা মজুরি দিলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, তাতে তাঁরাই লাভবান হবেন। কিন্তু তাঁরা ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করেন, যা পরবর্তী বছর ধরে কার্যকর করেন; যা শ্রমিকেরা প্রত্যাখ্যান করেন। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি কার্যকর করার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। শ্রমিকের যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করে সরকার মালিকদের সহযোগিতা করার জন্য শ্রমিক ও নেতাদের ওপর ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার-হামলা-মামলা, ছাঁটাই-বরখাস্ত ও দমন-পীড়ন শুরু করে।
২০১০ সালের পর কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত দুই বছরে নিম্নতম মূল মজুরি আট হাজার টাকার দাবিতে শ্রমিকেরা আন্দোলন করে আসছেন। সরকার শ্রমিকদের আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এবার শ্রম আইন সংশোধন করে ৫ শতাংশ মুনাফা থেকেও শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হলো। যদিও পোশাকমালিকেরা লভ্যাংশের ৫ শতাংশ কখনো শ্রমিকদের দিতেন না। ইতিমধ্যে ২০১৩ সালে নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও মজুরি বোর্ডে শ্রমিকদের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচিত না করে সরকার ও মালিকদের পছন্দের ব্যক্তিকে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি মনোনীত করা হয়েছে। ফলে আগের মতো মজুরি বোর্ড নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে এবারও অবিশ্বাস ও সন্দেহ রয়ে গেছে। পোশাকমালিক, মজুরি বোর্ডসহ অনেকে ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা তুলছে। বর্তমানে প্রাপ্ত মজুরিতে ক্ষয়কৃত ক্যালরি পূরণের মতো খাদ্য, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদনের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় পোশাকশ্রমিকেরা মাত্র ৪০-৪৫ বছর বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। ক্রমান্বয়ে শ্রমশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিল্প ও রাষ্ট্র হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। শ্রমিকদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির স্বার্থেই নিম্নে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। পুষ্টিবিজ্ঞানীর হিসাবমতে, একজন সাধারণ মানুষের দৈনিক দুই হাজার ৩০০ কিলোক্যালরি শক্তি প্রয়োজন। কিন্তু পোশাকশ্রমিকসহ কঠিন কায়িক শ্রম যাঁরা করেন, তাঁদের দৈনিক তিন হাজার কিলোক্যালরি প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় ক্যালরি অনুযায়ী দুই সন্তানসহ একটি পরিবারে খাওয়া খরচ, বাসা ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা, পোশাক ও অন্যান্য খরচ হিসাব করলে তা একজনের আয়ে কোনোভাবেই চলা সম্ভব নয়। পরিবারে দুজন মিলে আয় করলে সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান ও সবচেয়ে সস্তা খাবার খেয়ে কোনোভাবে চালানো সম্ভব। কিন্তু শ্রমিকের সন্তানের শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায় না।
পোশাকশিল্পের এলাকাগুলোতে সবচেয়ে সস্তা দরের ১০ ফুট বাই ১০ ফুট মাটির ভিটার ঘরের ভাড়া তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। তা ছাড়া ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিসহ চিকিৎসা খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। যাতায়াত বাবদ সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা। বাজারদরের সঙ্গে মিলিয়ে একটি পরিবারের জন্য খাবার ও পোশাকের হিসাব করলে তা ১২ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। ফলে একজন শ্রমিকের নিম্নতম মাসিক মূল মজুরি আট হাজার টাকা ন্যায্য এবং যৌক্তিক। ইতিমধ্যে মজুরি বোর্ড মজুরি নির্ধারণ করার জন্য তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। পোশাকশ্রমিকেরা অন্যান্য বারের মতো প্রতারিত হতে চান না।
শিল্পের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে পোশাকশ্রমিকদের যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবি মেনে নিতে হবে।
জলি তালুকদার: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।