Thank you for trying Sticky AMP!!

ফরিদপুরের মোসলেম প্রেস ও ছাইদ আলী খান

১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময় তিনি ও তাঁর বড় ভাই কলকাতা থেকে ট্রেনে করে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই যে যাত্রা, সেই যাত্রা শেষ হলো তাঁর ১৯ সেপ্টেম্বর।

মা-বাবা তখনো ওখানে। দাঙ্গা এড়াতে কলকাতা ছেড়েছেন। ট্রেনে করে নারায়ণগঞ্জে নেমে নদী পার হয়ে, সিঅ্যান্ডবি ঘাট দিয়ে হেঁটে ফরিদপুরে প্রবেশ করলেন। কয়েক দিনের যাত্রাপথ। দূরদর্শী ছিলেন বলেই হয়তো ওই দুর্যোগের সময়েও ছাপার যন্ত্রটা সঙ্গে আনলেন। ক্যান্ডেল প্যাটার্ন ছাপা মেশিন, সিসা লেটারিং পদ্ধতি। সে সময়ের সবচেয়ে দামি একটি ছাপযন্ত্র। ভারতে তাঁর ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছে শশধর দত্তের বিখ্যাত রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি দস্যুমোহনের কয়েকটি সিরিজ। জিজ্ঞেস করেছিলাম, হেঁটে এলেন, তা-ও কেমন করে সেই মেশিন আনা সম্ভব হয়েছিল? বলেছিলেন, রেখে আসতে পারিনি। আমরা দুই ভাই সবকিছু বিক্রি করে মেশিনটা কিনে সদ্য ছাপাখানা বসিয়েছি। তবে ইচ্ছে থাকলে উপায় যে একটা হয়ই, সেটা তখন দাঙ্গার সময় বুঝেছিলাম, মানে জীবনের অভিজ্ঞতা হলো।

ফেলে আসা দেশের স্মৃতি আর নতুন এক দেশ পাওয়ার সন্ধিক্ষণ সেটা। ফরিদপুর শহরের সবচেয়ে পুরোনো ‘মোসলেম প্রেস’টি মো. ছাইদ আলী খানের। সুফি মোতাহার হোসেনের প্রথম সনেট সংকলন তাঁর প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ফরিদপুরের প্রথম গ্রন্থ সপ্তাহ ও বইমেলার অন্যতম উদ্যোক্তা ছাইদ আলী খানের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত, ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত প্রথম গণচেতনার কবিতা সংকলন ‘শব্দের আকাঙ্ক্ষার সূর্য’। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অধ্যাপক আ ন ম সোবহান, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, এস এম শামসুল হক এবং সাংবাদিক আতাহার খানের লেখা নিয়ে প্রকাশিত এই সংকলনে ছিল বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে কবিতা। ১৯৬৫ সালে অধ্যাপক আ ন ম সোবহান সম্পাদিত ‘বলয়’ নামে ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত প্রথম সাহিত্য সংকলনটিও প্রকাশ করেছিলেন মো. ছাইদ আলী খান। ৭০-এর দশকে ফরিদপুর উন্নয়ন সংস্থার প্রকাশিত প্রত্যয় ও সৃষ্টিসুখের উল্লাস ম্যাগাজিন তাঁর প্রকাশনার। ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর টাউন থিয়েটার এবং সে বছরই ফরিদপুর ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন ছাইদ আলী খান। ১৯৬৫ সালে যখন চারটি ওয়ার্ড মিলে পৌরসভা কমিটি গঠন হয়, তিনি ছিলেন ঝিলটুলী-কুঠিবাড়ীর ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান। আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদক থাকাকালেই স্কুলটি উচ্চবিদ্যালয় হয়েছিল। এ সময় প্রয়াত রাধা গোবিন্দ সাহা, কিরণবালা বসু, আবদুস সাত্তার গুমাণী প্রমুখ বিদ্যানুরাগী ছিলেন পরিচালনা কমিটিতে। ছাইদ আলী খানের সুনাম ছিল তাঁর প্রকাশনার বানান সচেতনতা ও পারদর্শিতায়।

কালের পরিক্রমায় তাঁর লেটারিং প্রেসটি আধুনিকায়ন হয়েছে। বিন্যাসও বদলেছে, নামটা অপরিবর্তিত। এই প্রেসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মানিকদা নামে পরিচিত এক ব্যক্তির গল্প। মুক্তিযুদ্ধের আগে মোসলেম প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন মানিকদা। যুদ্ধ শুরু হলে তাতে অংশ নিয়ে একদিন বোমা তৈরির সময় দুই কবজি উড়ে যায় মানিকদার। যুদ্ধ শেষে সেই দুই অর্ধেক হাত নিয়ে আবারও এসে দাঁড়িয়েছিলেন ছাইদ আলী খানের সামনে। আবারও কাজ পেয়েছিলেন পুরোনো নিয়োগকর্তার কাছে। মানিকদা রপ্ত করে নিয়েছিলেন আঙুলবিহীন দুই বাহু এক করে ওতেই কলম ধরে প্রুফ দেখা আর ছাইদ আলী খান মানবিকতাকেই রেখেছিলেন ব্যবসায়িক বৈষয়িক জ্ঞানেরও আগে। মানিকদা থাকা পর্যন্ত অন্য কাউকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করেননি।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ফরিদপুরে তখন বেশ শীত। মনে হলো ডাক্তার ননী গোপাল সাহা চলে গেছেন কিছুদিন আগে। এখন আছেন তারাপদ স্যার, মো. ছাইদ আলী খানের মতো প্রবীণেরা। তাঁদের সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। বয়স হয়েছে, ছোটবেলায় তাঁদের চায়ের কাপে হরহামেশা টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে খেয়েছি। এখন আকারে বড় হয়ে আর যোগাযোগ রাখি না। ফোন করে বললাম, সকালে আটটার দিকে আসতে পারি। আলীপুরের বান্ধব পল্লিতে (হরিজন সম্প্রদায়ের আবাস) নিহত সাংবাদিক গৌতম দাসের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ১১টার মতো বেজে গেল। সাড়ে ১১টায় ঝিলটুলির মোসলেম প্রেসে প্রবেশ করে দেখি, ছাইদ আলী খান রোদে বসে তাপ নিচ্ছেন। এক গাল হাসি দিয়ে বললেন, তোমার জন্য নাশতা না খেয়ে বইসা আছি আর তুমি দুপুর বানায়া আইছ?
বললাম, কেমন পাকা ধানের মতো রোদ...দাঁড়ান একটা ছবি তুলি।
এই যে দ্যাখো এইখানে একটা গাঁদা ফুলের গাছ। এইখানে দাঁড়াই?
এটা গাঁদা?
ওই হইল।
আপনার লাগানো গাছ? বেশ, এখানেই দাঁড়ান।
এমনি এমনি হইছে। আমারে দ্যাখা যায় তোমার ক্যামেরায়? রোদ আসছে না মুখে?
জি দাদা সব ঠিক আছে, আপনি ভুলে যান আমি সামনে আছি। আব্বার সঙ্গে কথা বলতে থাকেন।
ও, তুমি হাসতে কইতেছ। ও মিলন তোমার মেয়ে তো আমারে মডেল বানাইছে...হা হা হা।
ক্লিক ক্লিক...।
ছবিটা পেলাম খুঁজে।

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম