Thank you for trying Sticky AMP!!

ফয়েজ, ইকবাল বানু এবং ভাষার রাজনীতি

হাম দেখেঙ্গের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও গজল গায়িকা ইকবাল বানু

নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির যেখানে শেষ, সেখানে স্থান নেওয়ার কথা স্থায়ী নীরবতা বা সশস্ত্রতার। কবিতা, গান বা ছবি সে জায়গা দখল করলে বিস্মিত হতে হয়। তবে সংস্কৃতি ও শিল্পকলার সেই শক্তি আছে। কালে কালে, বহু উপলক্ষে তা প্রমাণিত হয়েছে। নতুন করে সেই অভিজ্ঞতাই হলো ভারতে। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা ‘হাম দেখেঙ্গে’ নিয়ে সমগ্র ভারত এ মুহূর্তে তোলপাড়।

উর্দু কাব্যরীতিতে মুক্ত দৈর্ঘ্যের পদ্য ‘নজম’ নামে পরিচিত। ‘হাম দেখেঙ্গে’ একটা নজম। জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন এবং নতুন নাগরিকত্ব আইনবিরোধী যে আন্দোলন চলছে ভারতে, তাতে ফয়েজের এই নজম নিপীড়নের শিকার নিরস্ত্র প্রতিবাদী তরুণদের আশ্রয় হয়েছে। অনেকে একে তুলনা করছেন কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সংস্কৃতির রেনেসাঁ হিসেবে। তবে এই উচ্ছ্বাসে দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের সংগ্রামে এক নারীর অকুতোভয় সাহসের স্মৃতি খানিকটা বাদই পড়ে যাচ্ছে।

গান যখন প্রতিপক্ষ
ফয়েজের লিখিত হলেও ‘হাম দেখেঙ্গে’ জনপ্রিয় করেছেন গায়িকা ইকবাল বানু। একদা ঠুমরি ও দাদরা গাইতেন। পরে গজল এবং বিশেষভাবে সিনেমার গান গেয়ে জনপ্রিয় হন পাকিস্তানে। ফারসি গানের কারণে আফগানিস্তান পর্যন্ত তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল জীবদ্দশায়।

জীবনের শুরুতে অলইন্ডিয়া রেডিওতে গাইতেন ইকবাল বানু। জন্মও তাঁর ভারতের হরিয়ানায়। বিয়ের সূত্রে থিতু হন পাকিস্তানের মুলতানে। একদা ফয়েজের লিখিত ওই গান গেয়ে পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ইতিহাসের কৌতুকই বলতে হবে, ৩৪ বছর শেষে, একই গান এখন ভারতেও লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর কাছে একই রকম আবেদন নিয়ে উপস্থিত। উপরন্তু, তাতে হিন্দুত্ববাদ ও ভারতবিরোধী কিছু আছে কি না, সেটা খুঁজতে তদন্ত কমিটিও হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে এই গান শুনে উত্তর প্রদেশের কানপুর আইআইটিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলা হয়েছে। বিশাল ভারতের বিশাল ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে একটি গানে।

কবি বা শিল্পীদের অনেক সময় জাতীয়তার মোড়কে সাজিয়ে তোলেন শাসকেরা। কিন্তু তাঁদের কারও কারও সৃষ্টি আপন শক্তিতে সীমান্ত অতিক্রম করে অবলীলায়। অপর জনপদের স্বৈরসংস্কৃতিকে ভীত করে তোলে সেই সৃষ্টি। নতুন বিশ্বাসের ভিত্তি হয়ে ওঠে লাখো মানুষের। হালের ‘হাম দেখেঙ্গে’ উত্তেজনা সে কথাই জানাচ্ছে।

ফয়েজ ও ইকবাল বানু জীবিত থাকলে তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে অপর দেশের শাসকদের নাস্তানাবুদ অবস্থায় কৌতুকবোধ করতেন হয়তো।

শিল্প বনাম শাসকদের হাস্যকর অজ্ঞতা
‘হাম দেখেঙ্গে’র সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় স্বৈরতন্ত্রবিরোধী ইতিহাসের জড়াজড়ি বহু দশকের। বিশেষ করে ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক যখন ভুট্টোর নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা নেন, তখন থেকে। জিয়াউল হক অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসেছিলেন। সেই সীমালঙ্ঘনকে ন্যায্যতা দিতেই ক্রমে ধর্মীয় কার্ড ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। ফয়েজ তাঁর এই নজমে তারই উত্তর দিয়েছিলেন ন্যায়বিচারের ইসলামি মূল্যবোধকে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় তুলে ধরে। ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা সামরিক জুলুমশাহির বিরোধিতা করতে গিয়ে ইসলামের সুফি দর্শনের আশ্রয় নেন ফয়েজ। ওই সময় চলমান ইরান বিপ্লবও তাঁর মননে মায়াজাল বিস্তার করেছিল বলে কন্যা সেলিমা হাশমি সম্প্রতি দাবি করেছেন। তবে নজমটির দার্শনিক কাব্যময়তায় বুলেটের তীব্রতা দিয়েছিল প্রধানত ইকবাল বানুর কণ্ঠ। অসামান্য সেই গায়কির ঐতিহাসিক একটা পটভূমি আছে।

জিয়াউল হক শাসনের অন্যতম এক শিকার ছিল নারীর স্বাধীনতা। সমাজের রক্ষণশীল অংশের সমর্থন পাওয়ার এই কৌশল পাকিস্তানের সমাজে বেশ ভালো ফল দেয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ হঠাৎ শাড়িবিরোধী অবস্থান নেয়। মেয়েরা কী পরবে আর কী পরতে পারবে না, সেটাও তারা ঠিক করে দিতে চাইছিল। যেভাবে আজকের ভারতে শাসকেরা সংবিধানকে পাশে সরিয়ে রেখে বলতে চাইছে, ধর্ম হবে নাগরিকত্বের ভিত্তি।

জিয়াউল হক শাড়িকে বলতে চাইছিলেন ভারতীয় পোশাক। এসবই ছিল ক্ষমতায় থাকার ছলাকলা। তরুণ-তরুণী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে এর প্রতিবাদ ছিল। ওই সময়ই ১৯৮৬ সালে, ফয়েজের মৃত্যুর দুই বছর পর ইকবাল বানু লাহোরের এক অনুষ্ঠানে (স্টেডিয়ামে!) কালো শাড়ি পরে প্রায় ৫০ হাজার শ্রোতার সামনে ওই বিপ্লবী নজম গেয়েছিলেন। সেদিন লাহোরকে বিদ্যুতায়িত করেছিল ইকবাল বানুর সাহস ও ফয়েজের শব্দ। শ্রোতাদের গ্যালারি থেকে মুহুর্মুহু ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মাঝে ওই নজমের পুনর্জন্ম হয় সেদিন। মাইক ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ায় ওই অনুষ্ঠানের কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় না বলে শুনেছি। তবে তাতে এই গানের সীমান্ত ছেঁড়া আবেদনের ঢেউ থামেনি।

জিয়াউল হকের শাসনামলের দুই বছরের মধ্যে ১৯৭৯ সালে লিখিত হলেও নজমটি সামরিক শাসনবিরোধী সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে একত্র করতে পেরেছিল মূলত ইকবাল বানুর সাহস। বিনিময়ে টিভি-রেডিওসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিষিদ্ধ হন তিনি। কিন্তু কালোবাজারে চড়ে যায় তাঁর ক্যাসেটের দাম। ফয়েজকে দেশ ছাড়তে হয় অবশ্য তারও আগেই—ওই কবিতা লেখার বছর। নিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা যে শিল্পের আবেদন থামাতে পারে না, শাসকদের হাস্যকর সেই অজ্ঞতারও সাক্ষ্য হয়ে আছে ‘হাম দেখেঙ্গে’র ইতিহাস। জিয়া আজ নেই, কিন্তু নজমটি বেঁচে আছে এবং ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে।

ভাষার রাজনীতির বিরুদ্ধে তরুণেরা
এটা সবার জানা, কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের কোনো না কোনো শহরে ও বিদ্যাপীঠে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। দুটি বিষয় হামেশাই চোখে পড়ে এসব জমায়েতে। একটা হলো ‘আজাদি’ স্লোগান; আরেকটা দল বেঁধে ‘হাম দেখেঙ্গে’ গাওয়া।

কেউ কেউ ‘হাম দেখেঙ্গে’র বাংলা করেছেন ‘আমরা দেখব’। এতে মনে হয়, এই নজম যেন তৃতীয় কোনো নিষ্ক্রিয় দর্শকসত্তার কণ্ঠস্বর। আসলে ‘হাম দেখেঙ্গে’র তর্জমা হবে ‘আমরা সাক্ষী থাকব’। আরও স্পষ্টতায়: আমাদের সক্রিয়তায় ‘...অত্যাচার-নিপীড়নের ভারী পাহাড় তুলার মতো উবে যাবে...।’

[জব যুল্ম-ও-সিতাম কে কোহ-এ-গারান
রু-ই কি তারাহ উড় যায়েঙ্গে।]

তর্জমায় ঢাকাবাসী ভুল করলেও ভারতের তরুণ-তরুণীরা এই গানের অন্তর্নিহিত দার্শনিকতাকে ঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছে। গানটির মধ্য দিয়ে তারা জুলুমনির্ভর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবাধ্যতার কথা এবং ‘আজাদি’ স্লোগানের মাধ্যমে অনাগত এক মুক্তির আকুতি তুলে ধরছে বারবার। একটি শব্দ বা গানের কয়েকটি লাইন কীভাবে লাখ লাখ মানুষকে অপ্রচলিত কোনো সাংগঠনিকতায় বাঁধতে পারে, তার নজির ভারতের আজকের ক্যাম্পাসগুলো।

চলতি পরিস্থিতির বিয়োগান্ত দিকও আছে। ধর্মের নামে জিয়াউল হকের কাজকর্মের বিরোধিতা করে ফয়েজ ও ইকবাল বানু যা সৃষ্টি করেছিলেন, এখন বিজেপির গবেষকেরা তাতে হিন্দুবিরোধী উপাদান পেয়েছেন! জিয়াউল হক শাড়িকে বলছিলেন ভারতীয় পোশাক। প্রতিবাদ হিসেবে ইকবাল বানু শাড়ি পরে লাহোরে গান গেয়েছিলেন সেদিন। আজ ভারতীয় শাসকদের কাছেও একই গান অপ্রিয় ও তিক্ত লাগছে। ভারত-পাকিস্তানের চিরবৈরী শাসকশ্রেণি এ ক্ষেত্রে এককাতারে মিলেছে। আবার, উভয় দেশের প্রতিবাদীরাও তাঁদের আবেগের মৈত্রী খুঁজে পাচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতির উর্বর মাটিতে।

শোষণমূলক সামাজিক সম্পর্কের সবকিছু বহাল এবং আড়াল রাখতে জেনারেল জিয়ার ধর্মীয় জিগিরের মোকাবিলায় ফয়েজ নজমটিতে বলেছিলেন, খোদার আরশ থেকে ছদ্ম মূর্তি সরিয়ে মানুষকে স্থাপন করা হবে সেখানে। যে জীবন্ত মানুষ আজ অবজ্ঞার শিকার, পৃথিবীতে সেই স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষের মহিমান্বিত রাজত্ব কায়েমের আকাঙ্ক্ষা করেছেন ফয়েজ এভাবে:
যাব আরজ-এ-খোদা কে কা’বে সে
স্ব বুত উঠায়ে যায়েঙ্গে
হাম আহল-এ-সাফা মারদুদে-এ-হারাম
মসনদ পে বেঠায়ে যায়েঙ্গে

হিন্দুবাদের ব্যাখ্যাকার ও টীকাকাররা এখন মোদি সরকারকে বোঝাচ্ছেন, ফয়েজের এসব লাইনে মূলত হিন্দু দেব-দেবীকে উৎখাতের কথা বলা হয়েছে। ‘ঘৃণা ছড়াচ্ছে নজমটি’। কবিতার ভাব, দার্শনিক তাৎপর্য এবং তখনকার পাকিস্তানের প্রশাসনিক পটভূমির সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছে এভাবে। এই অপচেষ্টার লক্ষ্য আসলে আজাদির খোঁজে বের হওয়া তরুণদের সাংস্কৃতিকভাবে নিরস্ত্র করা। হিন্দুত্ববিরোধী হিসেবে পরিচয় করানো।

তবে প্রতিবাদী তরুণেরা কেবল সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধিতার চিহ্ন হিসেবে এই গান গাইছে না; এর মধ্য দিয়ে তারা ১৯৪৭-এর দেশভাগের সেই চেষ্টাকেও প্রত্যাখ্যান করছে, যেখানে রাজনীতির সঙ্গে ভাষাকে জড়িয়ে উর্দুসহ বহু বুলি নির্বাসন দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল এবং আছে। ১৯৪৭ থেকে ভাষার রাজনীতি সামনে রেখে পুরো ভারতকে হিন্দীকরণের যে জোরদার চেষ্টা চলছে, তরুণেরা তারও বিরুদ্ধে। কেবল ফয়েজই নন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইনবিরোধী সমাবেশগুলোয় হাবিব জালিব, রাহাত ইন্দোরির মতো জনপ্রিয় লিখিয়েদের কালাম পাঠ হচ্ছে অহরহ। পোস্টার, ব্যানার লেখা হচ্ছে গজল দিয়ে। লোকসভার বক্তৃতায় ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো।

ফয়েজ ও ইকবাল বানুর ‘হাম দেখেঙ্গে’র মতোই ভারতের রাহাত ইন্দোরি একটা লাইন বারবার উচ্চারিত হচ্ছে এখন ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে তরুণদের মুখে: ‘সবিই কা খুন শামিল ইহা কি মিট্টি মেÑকিসি কে বাপ কা হিন্দুস্থান তোডি হায়’।

একজন কবির এই বুলন্দ উচ্চরণ আসলে দক্ষিণ এশিয়ার সব উগ্র জাতীয়তাবাদীকে উদ্দেশ্য করেই। প্রত্যেক নাগরিকের, প্রতিটি ‘সংখ্যালঘু ভাষা’র আত্মবিকাশের অধিকার রয়েছে যেকোনো জনপদে। জাতীয় সম্পদ এবং জাতীয় সংবিধানে সবার ন্যায্য হিস্যার স্বীকৃতি থাকতে হবে। ঔপনিবেশিক শাসকেরা এ ভূখণ্ড সাত দশক আগে দু–তিনটি শাসকগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এই পুরো অঞ্চল যে শত শত ভাষা-ধর্ম-বর্ণের জনপদ, সেটা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। সব ভাষার সব কবি ও কবিতা তাই সম্মিলিত এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
[তথ্য সহযোগিতা: জাভেদ হুসেন]
আলতাফ পারভেজ: গবেষক