Thank you for trying Sticky AMP!!

মসরুর চৌধূরী

মসরুর চৌধূরী

চলে গেল মসরুর—বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত উদ্যোক্তা গ্রুপ ‘নন্দন’-এর চেয়ারম্যান মসরুর চৌধূরী। ৫ আগস্ট সকাল ১০টায় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাড়ি দিল না-ফেরার দেশে। মাত্র ৬১ বছর বয়সে চিরনিদ্রায় শায়িত হলো শবে কদরের সন্ধ্যায় তার জন্মস্থান সিলেটে, মহাসাধক হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সমাধির পাশে।
এমন করে মসরুরের মতো কেউ অকালে চলে গেলে কী করে মনকে বোঝানো যায়! বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের অনেকেই মসরুরকে চেনেন না, নামও হয়তো শোনেননি। সাম্প্রতিক কালে প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরীর মতো অগ্রপথিক উদ্যোক্তা অথবা অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মতো যশস্বী শিক্ষাবিদ অথবা হুমায়ূন আহমেদের মতো জননন্দিত কথাসাহিত্যিক সে ছিল না। কিন্তু আমরা যারা তার সঙ্গে রক্তের সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম অথবা তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম, তারা তো জানি, কী হারালাম। তার অকালমৃত্যু শুধু তার পরিবারের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনেনি, এ দেশের নবাগত বহু তরুণ উদ্যোক্তা, অসাম্প্রদায়িক অথচ ধর্মভীরু অনেক মানুষের কাছে তার মতো মানুষের এই হঠাৎ চলে যাওয়া বড়ই মর্মবিদারক।
সিলেটের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছিল মসরুর। শৈশবেই তার বাবা অকালপ্রয়াত হন। মা আফিয়া খাতুন ছিলেন সিলেটের প্রথম মুসলমান মহিলা চিকিৎসক। একদিকে এতদঞ্চলের রক্ষণশীল পরিবারগুলোর প্রসূতি মায়েদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তিতুল্য এক নারী, অন্যদিকে অকাল পিতৃহারা তিন সন্তানকে সুশিক্ষায় আলোকিত করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন আজীবন।
সে পরিশ্রমের ফসলও তুলেছিলেন তিনি। তাঁর তিন সন্তানই আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। সর্বকনিষ্ঠ ছিল মসরুর। এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিল। মুক্তিসংগ্রামের সময় ক্লাস বর্জন করে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করে সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নানা ধরনের সহায়তা কার্যক্রম। বন্ধু সালাম সরাসরি মুক্তিসংগ্রামে চলে যায়, মসরুর চেষ্টা করে চিকিৎসক মায়ের সাহায্যে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিতে। শতসহস্র নারী-পুরুষের আত্মত্যাগে একদিন স্বাধীন হয় প্রিয় মাতৃভূমি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে মসরুর যোগ দেয় বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ব্র্যাক-এ।
আশির দশকের গোড়ার দিকে মসরুর যুক্ত হয় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। অভিজ্ঞতা ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৮৭ সালে গড়ে তোলে কৃস্টাল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, যা মাত্র তিন বছরে দেশের বৃহত্তম সোডিয়াম সিলিকেট তৈরির কারখানায় পরিণত হয়। মসরুরের স্বপ্ন ছিল দেশটাকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়া। তাই মার্জিত রুচিসম্পন্ন, মৃদুভাষী মানুষটি একসময় গড়ে তোলে ‘নন্দন’ নামের থিম পার্ক। তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন প্রবাসী কয়েকজন বাঙালি, যাঁরা তারই মতো দেশের জন্য, দশের কল্যাণে কাজ করতে ব্রতী হয়েছিলেন। সাভারের ‘নন্দন পার্ক’ আজ দেশ ও দশের কাছে একটি অতিপরিচিত নাম। ঈদে, পূজা-পার্বণে, আনন্দ-উৎসবে ঢাকাবাসীর একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল।
এ তো গেল মসরুর জীবনচরিত। কিন্তু অনেক মানুষের দৃষ্টির আড়ালে সে এত কিছু করেছে, আমাদের মতো অনেক ঘনিষ্ঠজনের কাছেও তা জানা ছিল না।
আলোকিত একটি পরিবারের সন্তান মসরুর। শিক্ষার উন্নয়নে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে আলোকিত পথের যাত্রায় অনুপ্রেরণা জোগাতে তার যে একাগ্রতা দেখেছি, তার তুলনা হয় না। নিভৃতচারী হয়ে থেকে কাজ করেছে প্রথম আলোর টিমের সঙ্গে, টানা কয়েক বছর নন্দন পার্ক-এর দুয়ার খোলা রেখেছে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য। প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত এই আনন্দ উৎসবে একবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সারা দিন ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত কিশোর-কিশোরীদের সেই নির্ভেজাল আনন্দ, সেই সুস্থ বিনোদন, ‘অ্যাসিড-সন্ত্রাস’ আর ‘মাদক’কে ‘না’ বলার সেই প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণা—সবকিছু্ই আপ্লুত করেছিল আমার মতো সব অতিথি-অভ্যাগতকে।
সেদিন সেই বিশাল মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল মসরুর, অশ্রুকণায় চিকচিক করছিল তার দু চোখ, ঠোঁটে ছিল স্মিত হাসির আভা। আমাকে দেখে আবেগঘন কণ্ঠে বলল, ‘জানিস, এই প্রজন্মই দেশটাকে সামনে নিয়ে যাবে, আমাদের প্রজন্মের ব্যর্থতাগুলোকে মুছে দেবে।’ তখন কি জানতাম এই স্বপ্নদ্রষ্টা আর একটি বছরও আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে না! স্রষ্টার কি অমোঘ বিধান!
এবারেও সাড়ম্বরে ঈদ উদ্যাপন করল বাঙালি। হাটে-বাজারে, শপিং মলে, কাঁচাবাজারে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের কেনাকাটার ধুম, নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার কী প্রচণ্ড আগ্রহ, টিভি চ্যানেলগুলোতে ঈদ উৎসবের জমজমাট অনুষ্ঠান—সবই আছে, শুধু মসরুর নেই।
গত বছর ঈদের পরপর আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অর্ধশতাধিক সদস্য দল বেঁধে চলে গিয়েছিলাম ঢাকার উপকণ্ঠে সাভারে ব্র্যাকের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ট্রেনিং সেন্টার সিডিএমে। সবুজে, শ্যামলে নয়নাভিরাম সেই কেন্দ্র আমাদের পরিবারের নানা বয়সী সদস্যদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠেছিল সেদিন। নতুন প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে বৃষ্টিভেজা মিষ্টি বিকেলে গানের আসর বসাল মসরুর। হারানো দিনের অবিনাশী সব গানের সঙ্গে যুক্ত হলো লালন শাহ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের কালজয়ী সংগীতমালা।
নতুন প্রজন্মই বা কম যায় কিসে? আধুনিক পপসংগীতও তাই বাদ রইল না। আমার এক ভ্রাতৃবধূ মসরুরকে অনুরোধ করলেন হারানো দিনের একটি গান গাইতে। হুট করে সে প্রশ্ন করে বসল, ‘গান গাইতে তো অনুরোধ করলে, বুঝলাম এটি তোমার পছন্দের গান। কিন্তু বলো তো এটির কথা ও সুর কে দিয়েছেন?’ আমার আত্মীয়া একটু বিব্রত হলেন, পছন্দের গান; কিন্তু এত কিছু কি মনে থাকে? মসরুর উত্তরটা দিয়ে বলল, ‘এটি শচীন দেববর্মনের। একটি কথা মনে রেখো, গান ভালোবাসলে তার কথা, সুরস্রষ্টা ও শিল্পীকেও মনে রাখতে হবে, সম্মান দিতে হবে তাঁদের। তবেই না সংগীতবোদ্ধা হতে পারবে।’ সেদিন মসরুর কথাগুলো হালকাভাবেই নিয়েছিল উপস্থিত সবাই, কিন্তু আজ পেছনে তাকিয়ে মনে পড়ছে, যেকোনো আসরে প্রতিটি গান পরিবেশনের আগে মসরুর পেছনের ইতিবৃত্ত, কথা ও সুরকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে শুরু করত না। তার সংস্কৃতিবোধ, তারুণ্যের প্রতি মমত্ববোধ আর মানুষের জন্য ভালোবাসা আমাদের মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত থাকবে চিরকাল।
তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাতে মসরুর যে আগ্রহ দেখেছিলাম, আমাদের অনেক প্রখ্যাত পরিচিতজনের মাঝেও তার প্রকাশ অনেক সময় দেখিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি থাকার সুবাদে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করত সে, প্রজন্মের ফারাক সেখানে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। একজন শিক্ষক না হয়েও কখনো বন্ধুর মতো, কখনো বা মুরব্বির ভূমিকায়, আবার কখনো অভিভাবকসুলভ আচরণে তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে টানত, পরামর্শ দিত। তারই উদ্যোগে ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের জন্য আয়োজিত একটি মতবিনিময় সভায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। বিশাল হলরুম ভর্তি একঝাঁক তরুণ-তরুণীর সমুজ্জ্বল উপস্থিতি দেখে আন্দোলিত হয়েছিলাম। মসরুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমি তো একজন উন্নয়নকর্মী, চাকরি-বাকরি বা উদ্যোক্তার অভিজ্ঞতা তো আমার নেই, এদের আমি কী পরামর্শ দেব?’ সেই স্মিত হাসি, সেই উজ্জ্বল আভা মসরুর চোখেমুখে, বলল, ‘সে জন্যই তো তোকে আসতে বলেছি, এদের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করেছি। মাঠে-ময়দানে এ দেশের সংগ্রামী মানুষ কীভাবে শত প্রতিকূলতার মাঝেও দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও এ দেশের কৃষক কীভাবে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে, নারী কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, কেমন করে কোন জাদুমন্ত্রে জিডিপি ৬ শতাংশের বেশি থাকছে—গল্প করে করে এগুলোই বলবি আরকি? বুঝিস না, এই প্রজন্মকে হতাশ হতে দেওয়া চলবে না, এদের জন্য প্রয়োজন রোল মডেল, প্রয়োজন অনেক অনুপ্রেরণা।’
মসরুর স্বপ্ন কবে পূরণ হবে জানি না, নতুন প্রজন্ম কখন কীভাবে আমাদের ব্যর্থতার গ্লানিগুলো মুছে দেবে, তা-ও জানি না। শুধু বুক বেঁধে থাকি, বিশ্বাস করি দেশটা এগিয়ে যাবে, শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে। মসরুর আজ অনন্তলোকের অধিবাসী, সৃষ্টিকর্তা তার মঙ্গল করুন।
রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।