এভাবে নিরীহ মানুষ হত্যা করল কারা?
সিরিয়ার আসাদ সরকার রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে—এই অজুহাতে দেশটির ওপর আমেরিকার ঝটিকা বিমান হামলার তৎপরতা রাশিয়ার পাল্টা হুমকির মুখে আপাতত থেমেছে। কিন্তু আমেরিকা ও তার মিত্রদের ওপর ভরসা রাখা কঠিন। এর আগে তারা রাশিয়ার আপত্তি উপেক্ষা করেই ইরাকে হামলা চালিয়েছে। তার আগে বিশ্বজনমতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আল-কায়েদা ও তালেবান মারতে আফগানিস্তানে ব্যাপক বিধ্বংসী হামলা চালিয়ে সাধারণ আফগানদের আক্ষরিক অর্থেই সর্বনাশ করেছে। ইরাকের ব্যাপারে তাদের অজুহাত ছিল সাদ্দাম হোসেনের ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, সেটা বিশ্ববাসীর নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছে, সাদ্দামের সে রকম কিছু ছিল না। এবার সিরিয়ার আসাদ সরকার রাজধানী দামেস্কের শহরতলিতে প্রাণঘাতী সারিন গ্যাসসহ অন্যান্য স্নায়ুবিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে অনেক লোকের প্রাণহানির কারণ ঘটিয়েছে—এই অভিযোগের অকাট্য প্রমাণ মেলেনি। তাঁর প্রতিপক্ষ বিদ্রোহীরাও যে স্নায়ুগ্যাস ব্যবহার করে থাকতে পারে—এমন অভিযোগও উঠেছে। ব্রিটিশ সংবাদিক রবার্ট ফিস্ক লন্ডনের দৈনিক দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় লিখেছেন, রাসায়নিক অস্ত্রে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আসাদপন্থী হিজবুল্লার কয়েকজন সদস্যেরও খোঁজ তিনি পেয়েছেন, যাঁরা লেবানন থেকে সিরিয়ায় এসে আসাদ সরকারের পক্ষে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
আসাদের সরকারকে ‘শায়েস্তা’ করতে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তাঁর মিত্রদের এমন ব্যগ্র হয়ে ওঠার পেছনে অনেক ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ আছে। কিন্তু সেসব কথা ওবামাদের মুখ ফুটে বলতে নেই। তাঁরা তো পৃথিবীর অভিভাবক, মানবজাতির নিরাপত্তা অটুট রাখার ভার নিয়েছেন। আসাদকে শায়েস্তা করা তাঁদের নৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে!
কিন্তু আমেরিকান শাসকদের নৈতিকতা ভয়ংকর স্ববিরোধিতায় ভরা। আজকে তাঁরা সিরিয়ার মানুষের ওপর আসমান থেকে গজব নামাতে চাইছেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে সিরিয়া সরকার নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। অথচ ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে সাদ্দাম-সরকারকে সহযোগিতা করেছিল। এ সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আমেরিকান সাময়িকী ফরেন পলিসি। সম্প্রতি প্রকাশিত সিআইএর গোপন নথিপত্র ও মার্কিন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিগ্যান প্রশাসন ১৯৮৩ সালের শুরুতেই জানতে পেরেছিল যে ইরাক ইরানের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে। তখন রিগ্যান প্রশাসন স্থির করে, তারা ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার চালাতে দেবে এই প্রত্যাশায় যে তার ফলে যুদ্ধের মোড় ফিরে যেতে পারে ইরাকের পক্ষে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল, যুদ্ধে যেন ইরাকেরই জয় হয়। কয়েক বছর পর যুদ্ধ যখন তুঙ্গে ওঠে এবং ইরান যখন ইরাকের বসরা দখল করে নিতে যাচ্ছিল, তখন সিআইএর এক টপ-সিক্রেট রিপোর্টে সে পরিস্থিতি প্রেসিডেন্ট রিগ্যানকে জানানো হলে তিনি সেই রিপোর্টের মার্জিনে ‘অ্যান ইরানিয়ান ভিক্টরি ইজ আন-একসেপটেবল’ লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্রাংক কারলুসিকে। যেকোনো মূল্যে ইরানকে পরাজিত করতে হবে—এই অবস্থান নিয়ে আমেরিকা ইরাকের সব অন্যায় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেনি, নানাভাবে সহযোগিতাও করেছে। এর অকাট্য প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে মার্কিন গোয়েন্দাদেরই গোপন নথিপত্র থেকে।
ইরানের বিরাট অঞ্চল দখলের মধ্য দিয়ে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু করেন সাদ্দাম; ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে। নভেম্বরেই তিনি ইরানের বিরুদ্ধে পরীক্ষামূলকভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু করেন। অবশ্য তখন ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন শুরু হয়েছে মাত্র। পরে ১৯৮১ থেকে পরবর্তী এক দশকে প্রায় চার হাজার টন রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করেছেন সাদ্দাম, শেষের দিকে জীবাণু অস্ত্রও। এসব নিষিদ্ধ অস্ত্র উৎপাদনে তাঁকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রিয়া। ১৯৮৩ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে ইরাক ব্যাপকভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। সেসবের মধ্যে ছিল প্রথম প্রজন্মের মাস্টার্ড গ্যাস থেকে শুরু করে অতিমাত্রায় বিষাক্ত, স্নায়ুবিধ্বংসী, প্রাণঘাতী গ্যাস টাবুন ও সারিন। রিগ্যান প্রশাসনের সবই জানা ছিল। ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইরানের বিরুদ্ধে ইরাক কখন কোথায় কী ধরনের নার্ভ গ্যাস কত মাত্রায় ব্যবহার করেছে, মার্কিন গোয়েন্দারা তা রিগ্যান প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশদভাবে জানাতেন এমন প্রমাণ পত্রিকাটি পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সিআইএ যখন জানতে পারে যে ইরান ইরাকের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কিছু দুর্বল জায়গা শনাক্ত করেছে এবং সে অনুযায়ী লক্ষ্যাভিমুখী আক্রমণ চালিয়ে ইরাককে মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত করতে যাচ্ছে, তখন আমেরিকা স্যাটেলাইট ব্যবহার করে ইরানের সেবাবাহিনী, তাদের লজিস্টিক সুবিধা প্রদানকারী নানা স্থাপনা ও ইরানি বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অবস্থান সম্পর্কে বিশদ ছবি ও মানচিত্র সরবরাহ করে ইরাকি বাহিনীকে। সেসবের ওপর ভিত্তি করেই ইরাক ১৯৮৮ সালের শুরু থেকে পর পর চারটি বড় ধরনের আক্রমণ চালানোর আগে মাস্টার্ড ও সারিন গ্যাস ব্যবহার করে ইরানিদের ওপর। ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়, ইরান বসরা দখলে নিতে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়।
ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদনের কারখানাগুলোর অবস্থান সম্পর্কেও আমেরিকান গোয়েন্দারা সবকিছু জানতেন এবং রিগ্যান প্রশাসনকে তা জানাতেন। স্নায়ুগ্যাস তৈরির কাঁচামাল তারা কোন কোন উৎস থেকে সংগ্রহ করছিল, কোথায় কোন কারখানায় তারা বিষাক্ত স্নায়ুগ্যাসবাহী আর্টিলারি গোলা ও বোমা তৈরি করছিল, সেসব সম্পর্কেও তাঁরা নিয়মিত গোপন রিপোর্ট তৈরি করে ওয়াশিংটনে পাঠাতেন। ইরানের বিশাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ইরাকিরা যখন নাস্তানাবুদ হচ্ছিল, তখন তারা বিষাক্ত মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগ করে ইরানি সেনাদের ঘায়েল করার কৌশল নেয়। মার্কিন গোয়েন্দারা গোপন নথিতে ওয়াশিংটনকে তখন জানান, ইরাক আরও দ্রুত বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস উৎপাদনের জন্য ইতালি থেকে যন্ত্রপাতি কিনতে যাচ্ছে। সাদ্দাম হোসেন প্রাণঘাতী স্নায়ুগ্যাস কেবল ইরানিদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেননি, নিজের দেশের কুর্দিদের ওপরও গণহত্যা চালিয়েছেন প্রাণঘাতী সারিন গ্যাস ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সেসব কিছুই দেখেছে, কিন্তু কোনো বিরোধিতাই করেনি। কারণ তখন সাদ্দাম ছিলেন তাদের মিত্র; মিত্রের অন্যায় ধরতে নেই!
কেমিক্যাল উইপন্স কনভেনশন নামে এক আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন, মজুত ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। সিরিয়া এই নিষিদ্ধ কাজ করেছে বলে ওবামা ও তাঁর মিত্ররা প্রেসিডেন্ট আসাদকে শাস্তি দিতে সিরিয়ার ওপর আক্রমণ চালাতে চাইছেন। কিন্তু সিরিয়ার পাশেই ইসরায়েল যে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত গড়ে তুলেছে, তা নিয়ে ওবামা ও তাঁর মিত্ররা কখনো কিছু বলেন না। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর গোপন নথি থেকে ইসরায়েলের রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের বিরাট ভান্ডার সম্পর্কে বিশদ তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রুশ সংবাদ পোর্টাল আরটি ডটকম। দামেস্কের কাছে বিষাক্ত সারিন গ্যাস ব্যবহারের জন্য শুধু আসাদ সরকারকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, কিন্তু বিদ্রোহীরাও যে সারিন ব্যবহার করে থাকতে পারে, এমন অভিযোগ আমলেই নেওয়া হচ্ছে না। পশ্চিমা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এই অভিযোগ প্রচারও পাচ্ছে না। তার কারণ, সন্দেহ করা হচ্ছে, আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের বিষাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র দিয়েছে ইসরায়েল। আসাদ সরকারকে ধ্বংস করতে আমেরিকা-ইসরায়েলের এখন আল-কায়েদা, আল-নুসরার মতো ‘ভয়ংকর’ ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদেরও টাকা-পয়সা, আগ্নেয়াস্ত্র, এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রের জোগান দিতেও কুণ্ঠা হচ্ছে না!
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শান্তি ইত্যাদি নিয়ে আমেরিকান শাসকদের সুবচনের শেষ নেই। আমেরিকা দাবি করে, এসব আদর্শেই সে বলীয়ান। কিন্তু এই মিথ্যা গৌরব যে গোটা বিশ্ববাসীকে আমেরিকার দিকে তাকিয়ে করুণ পরিহাসে বিদ্ধ করে, ওবামা ও তাঁর সভাষদ কি তা টের পান?