শুকন মিয়াদের দায়িত্ব কে নেবে
দলীয় সভায় এক মন্ত্রী নাকি বলেছেন, ‘কবে না জানি আবার বজ্রপাতে মৃত্যুর জন্য আমাদের (সরকার) দায়ী করে বিবৃতি দিয়ে বসে ওরা।’ বিপদে থাকা বিরোধীদের নিয়ে তাঁর রং-তামাশা নতুন কিছু নয়। মন্ত্রী যা-ই বলুন, বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল থামানোর দায়িত্ব কিন্তু সরকারেরই। হাসিঠাট্টার বিষয় নয়।
বজ্রপাত, না নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া
নেত্রকোনার মদন উপজেলার নায়েকপুর ইউনিয়নের গাবরতলা গ্রামের শুকন মিয়ার কান্না থামছে না। দিনমজুরির টাকা জমিয়ে কেনা তিনটা গরু এক বজ্রপাতেই শেষ। ৫৫ বছরের পরিশ্রমের ফসল ছিল গরুগুলো। সেই সময় সারা দেশে বজ্রপাতে নিহত হন ২২ জন। এ বছরের ৮ জুন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ২১৩। এক দিনেই ৩৭ জন মারা যান (৬ জুন)। পরদিন পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে ২৬ জনের মৃত্যু ঘটে। নেপালে বন্যা বা পাহাড়ধস নয়, এখন বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন বজ্রপাতে। গত চার বছরে সেখানে মারা গেছেন ৯৩০ জন। মানুষের পাশাপাশি অনেক গবাদিপশুও মারা যায় বজ্রপাতে। গরিব মানুষকে ‘নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ায়’ বোধ করি বজ্রপাতের ভূমিকা চমকে দেওয়ার মতো।
কীভাবে নিঃস্ব করছে বজ্রপাত
অতিমারিতে জর্জরিত পৃথিবীতে শুকন মিয়ার কি ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো রাস্তা আছে? অধিকাংশ সময় পরিবারের মূল কর্মক্ষম ব্যক্তিকে কেড়ে নিচ্ছে বজ্রপাত। তাদের হারিয়ে বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের ৬ জুন পর্যন্ত মারা যাওয়া ১ হাজার ৭৩৮ জনের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই ছিলেন পরিবারের একমাত্র অন্ন জোগানদার। সংসারের মূল আয়রোজগারের কান্ডারি বিনা নোটিশে চলে গেলে সংসারে মেরামত–অযোগ্য ধস নামে। বজ্রপাতে আহত হয়ে বেঁচে থাকলেও আগের মতো কর্মক্ষমতা থাকে না। আমাদের দেশে বজ্রপাতে আহতদের হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, বজ্রপাতে নিহতের চেয়ে ৪-৫ গুণ মানুষ আহত হন। নেপালের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ জেলা মাখনপুরে গবেষকেরা দেখেছেন, প্রতি ৭০ জন নিহতের বিপরীতে সেখানে আহতের সংখ্যা প্রায় ৩০০। এই আহত মানুষেরাও দিন দিন নিঃস্ব হতে থাকেন। ২০১৯ সালের ২ মে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের গোপীনাথপুর গ্রামের আবদুল আজিজ বজ্রপাতে আহত হন। তিনি এখন কানে শোনেন না, অস্বাভাবিক আচরণ করেন, কথা বলতে অসুবিধা হয়, শ্বাসকষ্ট এখন তাঁর নিত্যসঙ্গী। রায়গঞ্জ পৌর এলাকার গুনগাতিতে নিজের ছোট্ট মুদিদোকানে বসা অবস্থায় বজ্রপাতে আহত হন মজনু মিয়া (৫০)। বাজের প্রচণ্ড শব্দে তিনি জ্ঞান হারান। তিনি এখন খুব অসুস্থ। কথা বলতে পারছেন না। এঁরা এখন কর্মহীন, পরিবারের বোঝা।
বজ্রপাতে শিশুমৃত্যুর হার বাড়ছে
কোভিডের আগে ২০১৯ সালে নিহত হয় ২২টি শিশু। কোভিড বছর ২০২০ সালে এক লাফে সেই সংখ্যা হয় ৮০। এ বছরের ৬ জুন পর্যন্ত নিহত ৫০টি শিশু। এখনো প্রায় অর্ধেক বছর বাকি। চলতি বছর বজ্রপাতে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর হার সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বজ্রপাতে নিহত এসব শিশুর প্রায় সবাই স্কুল বা মাদ্রাসার নিয়মিত শিক্ষার্থী ছিল। করোনার কারণে লেখাপড়া বন্ধ, তাই শিক্ষার্থীদের এখন ‘কাজ করে খেতে হচ্ছে’। শিশুশ্রমে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা। বাবা বা অভিভাবকদের কাজ নেই। কাজেই সংসারের খরচ জোগাতে শিশুদের মাঠঘাটে যেতে হচ্ছে। ফলে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি আগের থেকে এখন অনেক বেশি।
২০১৬ সালে তিন শতাধিক মৃত্যুর পর বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার। শুরু হয় বজ্রপাত রোধে বিশেষ পরিকল্পনা এবং সতর্কীকরণ কর্মসূচি। জ্ঞান অর্জনের জন্য কর্মকর্তাদের পাঠানো হয় বিদেশে। কথা ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা বজ্রপাত নিরোধক টাওয়ারের নকশা চূড়ান্ত করে তা স্থাপনের ব্যবস্থা নেবেন। কে জানে, এখন তাঁরা কোথায় কেমন আছেন?
বজ্রপাত কি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা
রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মতো বজ্রপাত একটি স্বাভাবিক ঘটনা। জমির উর্বরতা, মাছের প্রজননেও ভূমিকা রাখে বিজলি। চা-বাগানসহ প্রাকৃতিক বনভূমিগুলোর শক্তি বাড়াতে বজ্রপাতের প্রয়োজন। বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয়। কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির টমাস স্মিডলিন ‘রিস্কফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণায় বলেছেন, ‘প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়। বছরে প্রায় দেড় শ মানুষের মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে এলেও প্রকৃতপক্ষে তা পাঁচ শ থেকে এক হাজার।’
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ ফারুখ বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা অনেক বেশি। দেশের আয়তনের তুলনায় হতাহতের সংখ্যাও অনেক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জে। প্রাণহানিও বেশি
সেখানে। গত ১২ বছরে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি বিশ্লেষণ করে দুর্যোগ ফোরাম দেখেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হাওর এলাকাই এককভাবে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা। এ ছাড়া যশোর-সাতক্ষীরা অঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ও লালমনিরহাট এলাকাতেও বজ্রপাতে হতাহতের ধারাবাহিক প্রবণতা আছে।
বজ্রপাত বাড়ছে?
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড রম্পস বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতগুলো আরও ধ্বংসাত্মক হবে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রতি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাতের হার ১০ থেকে ১২ শতাংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। তবে এসবই অনুমাননির্ভর ভবিষ্যদ্বাণী। নির্ভরযোগ্য অতীত তথ্য না থাকার কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে কি না, এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে বজ্রপাতের কারণে মানুষের হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
পদক্ষেপ ও আশু করণীয়
২০১৬ সালে তিন শতাধিক মৃত্যুর পর বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার। শুরু হয় বজ্রপাত রোধে বিশেষ পরিকল্পনা এবং সতর্কীকরণ কর্মসূচি।জ্ঞান অর্জনের জন্য কর্মকর্তাদের পাঠানো হয় বিদেশে। কথা ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা বজ্রপাত নিরোধক টাওয়ারের নকশা চূড়ান্ত করে তা স্থাপনের ব্যবস্থা নেবেন। কে জানে, এখন তাঁরা কোথায় কেমন আছেন? সারা দেশে কমপক্ষে ১০ লাখ তালগাছ রোপণ করার কথা। ২০১৮ সালে বলা হয়েছিল, প্রায় ২৮ লাখ বীজ সংগৃহীত হয়েছে এবং লাগানো হচ্ছে। আবহাওয়া দপ্তর লেগে যায় বজ্রপাতের আগাম সংকেত জানতে ‘লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর’ বসানোর কাজে। খরচ ধরা হয়েছিল ৬২ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা আটটি ডিটেকটিভ সেন্সরের যন্ত্রপাতির পেছনেই চলে যায় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এগুলো সব ঠিকঠাক কাজ করলে ১০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা আগে বজ্রপাতের সংকেত দেওয়া যাবে। তাতে প্রত্যন্ত হাওরে ব্যস্ত কৃষকের কী লাভ হবে!
তালগাছসহ সব বড় গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। নড়াইলের সদর উপজেলার তুলারামপুর হাট, মাইজপাড়া হাট ও কালিয়া উপজেলার চাচুড়ি-পেড়লি হাটসহ বাংলাদেশের আনাচকানাচে বসা ডোঙ্গার (তালগাছের নৌকা) হাট বন্ধ করে দিতে হবে। এসব হাটকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর হাজার হাজার তালগাছ কাটা পড়ে। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড বা লাইটেনিং এরেস্টার লাগাতে হবে। আহত মানুষের চিকিৎসার একটা মানসম্মত প্রটোকল তৈরি করে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর চিকিৎসকদের সেটা জানিয়ে দিতে হবে। সবার আগে নিয়ত ঠিক করতে হবে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর দিল খোলা চেষ্টার নিয়ত।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com