Thank you for trying Sticky AMP!!

সাধারণের অসাধারণ নিমাই ভট্টাচার্য

কথাসাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য: ফাইল ছবি

অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার মাগুরা থেকে যাত্রা শুরু করে কলকাতার রানীকুঠিতে পরিসমাপ্তি, এই দীর্ঘ যাত্রাপথের আনন্দগানে নিমাই ভট্টাচার্যকে কখনো পরিশ্রান্ত পথিক বলে একটিবারও বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে মনে হয়নি। দেশভাগের যন্ত্রণা এবং ক্লিন্নতাকে একমাত্র উপজীব্য করে, সেই বেদনার কথোপকথনকেই তিনি একমাত্র সাহিত্য উপাদানের মর্মবস্তু বলেও একটিবারের জন্য নিজের সৃষ্টিতে উপস্থাপিত করেননি। সমকালীন দুনিয়ায় মানবতার সংকট এবং সেই সংকট অতিক্রম করার জন্য মানুষের যে সংগ্রাম—এটাই ছিল বহুধাবিস্তৃত নিমাই ভট্টাচার্যের সৃষ্টির সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর সব থেকে বড় চারিত্রিক লক্ষণ।

পেশাগত কারণে বড় একটা সময় নিমাই ভট্টাচার্যের জীবনে কেটেছে প্রবাসে। বিশেষ করে দিল্লিতে। দণ্ডমুণ্ডের কর্তাব্যক্তিদের অলিতে-গলিতে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। রাষ্ট্রযন্ত্রের কেষ্ট-বিষ্টু থেকে শুরু করে, গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ। অনেকেই বলে থাকেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের এমন উত্থান-পতন, বন্ধুর, রেখাপাতিত জীবনের কাহিনি তিনি জানতেন, যেটা হেমন্তের জীবনের বহু গবেষক আজ পর্যন্ত জানেন না।

রাজপথ থেকে গলিপথের সুলুক-সন্ধানের ভেতর দিয়ে, জীবন-জীবিকার লড়াইটি কীভাবে সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে, একদম আটপৌরে গদ্যের ভেতর দিয়ে, নিমাই ভট্টাচার্য সেটা দেখিয়েছেন। ‘মেমসাহেব’ নিমাই ভট্টাচার্যের বহুলপঠিত উপন্যাস। বহুল প্রচারিত গ্রন্থ হলেও তাঁর নিজের একটু বেশি ভালো লাগা বই ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ তিনি উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁর নিজের প্রিয়তম কবি শামসুর রাহমানকে।

শামসুর রাহমানের চিন্তা-চেতনার সর্বজনীনতাকে মর্যাদা দিয়ে এই ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থের ভেতরে ভারতকথার গ্রন্থিমোচনের, এক অনবদ্য প্রয়াস নিমাই ভট্টাচার্য করেছেন তাঁর অননুকরণীয় গদ্যের মাধ্যম দিয়ে। ব্রিটিশ ভারতে এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জীবন ঘিরে ভারতীয়দের ছিল অসাধারণ ঔৎসুক্য। কখনো ঘৃণা, কখনো-বা করুণা। এই সমষ্টির ধারণাকে ইতিহাসের দর্পণে প্রতিষ্ঠা করে, তাঁদের ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের কালচক্রের বিবর্তনের ধারাবিবরণী নিমাই ভট্টাচার্য রচনা করেছেন। এই রচনার যে আঙ্গিক, তেমন কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সমকালীন সৃষ্টিতে খুব বেশি একটা আমাদের চোখে পড়ে না।

এ ধরনের প্রেক্ষিত রচনার বেলায়, জনপ্রিয় হওয়ার তাগিদে, এক ধরনের যৌন উসকানি দেওয়ার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রে লেখকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। নিমাই ভট্টাচার্য তাঁর ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ থেকে শুরু করে, বহুল পঠিত উপন্যাস ‘মেমসাহেব’ কিংবা ‘কয়েদি’ কিংবা ‘চীনাবাজার’, ‘স্বপ্নভঙ্গ’ , ‘ঈশানী’, ‘উর্বশী’, ‘পিয়াসা’, ‘চেকপোস্ট’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’ প্রভৃতি উপন্যাসে একটি বারের জন্যও অপ্রয়োজনে আনেননি।

কেবল নিজের লেখাকে রগরগে করে তোলার চেষ্টায়, কিংবা বাজারচলতি করে তোলার তাড়নায় যৌনতাকে উপস্থাপিত করেননি নিমাই। মানবজীবনের আদিম প্রবৃত্তি নিমাইয়ের লেখায় যে আসেনি, তা নয়। কিন্তু সেই অংশগুলো পাঠের প্রতিক্রিয়ায় পাঠকের ভেতরে একটিবারের জন্য কোনো ধরনের শারীরিক উত্তেজনা তৈরি হবে না। তৈরি হবে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণা। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা আমাদের জীবন-জীবিকার তাগিদে, মনুষ্যত্বের অপমান, বাস্তবতা ঘিরে এক ধরনের বেদনায় আমাদের পৌঁছে দেয়।

ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ফিল্মের সেই রক্তমাখা অশ্রুকণায় গাঁথা চিত্রমালার মতো হয়ে, যন্ত্রণাকে সাহিত্যে উপস্থাপিত করার ক্ষেত্রে নিমাই ভট্টাচার্য ছিলেন অনন্যসাধারণ। তাঁর সমকালীন কোনো কোনো লেখকের ভেতর যেভাবে দুর্বোধ্যতার প্রতি এক ধরনের রোমাঞ্চকর তৃষ্ণা কাজ করে, নিমাই ভট্টাচার্যের আটপৌরে সৃষ্টিতে কিন্তু একটিবারের জন্য সেসব আমরা দেখতে পাই না। তাই নিমাই ভট্টাচার্যকে একটিবারও আমাদের দুর্বোধ্য, কঠিন, কোনো কল্পলোকের বাসিন্দাকে সাহিত্যিক বলে মনে হয় না।

তাই বলে নিমাই ভট্টাচার্যের সৃষ্টিতে কখনো এমন কিছু তরল উপস্থাপনাও নেই, যার জেরে তাঁকে আমরা বাজারচলতি সাহিত্যিক বলে অভিহিত করতে পারি। সমাজবিজ্ঞানকে সমাজবীক্ষণে রূপান্তরিত করার এক ধরনের অদ্ভুত জাদুস্পর্শ নিমাই ভট্টাচার্যের সামগ্রিক সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে। অথচ এই বহুমুখী উপস্থাপনায় একটিবারের জন্যও কোনো প্রচারকামিতার গড়নে নিজের সাহিত্যকে উপস্থাপিত করেননি নিমাই ভট্টাচার্য।

দেশভাগ তাঁর জীবনের এক স্থায়ী ক্ষত ছিল। জন্মভূমির প্রতি তৃষ্ণাও তাঁর ছিল অন্তহীন। সেই তৃষ্ণা নিবারণের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্যায়ের সঙ্গে নিমাই ভট্টাচার্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। দিল্লিতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় তাঁর ভূমিকার সাক্ষ্য হিসেবে সৈয়দ হাসান ইমামের মতো ব্যক্তিত্ব এখনো আমাদের মধ্যে আছেন।

এই সংযোগকে কিন্তু নিমাই ভট্টাচার্য ব্যবহার করে গেছেন বাঙালির সর্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ এবং সম্প্রীতির প্রতি এক ধরনের প্রবল অনুরাগ হিসেবে। এই অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে, কেবল সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে যে তিনি তাঁর সামগ্রিক চেতনাকে আবদ্ধ রেখেছেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সাহিত্য যাতে বইয়ের আলমারির একটি সম্ভ্রান্ত সামগ্রী হিসেবেই না থেকে যায়, তার বদলে সব পাঠকের, বিশেষ করে বাঙালি হৃদয়ের অন্তস্তলের বস্তু হয়ে উঠতে পারে বই, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি ছিল না নিমাই ভট্টাচার্যের।

প্রান্তিক চরিত্র, নিম্নবর্গীয় চরিত্র, সেই সঙ্গে অভিজাত—অত্যন্ত উচ্চমার্গের, উচ্চ কৌলীন্যের চরিত্রকে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের সৃষ্টিতে। তবে কখনোই উচ্চমার্গের প্রতি, উচ্চবর্ণের প্রতি, উচ্চ ধনগৌরবের প্রতি নিজের আকর্ষণ তিনি প্রকাশ করেননি। এ ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিল উচ্চচিন্তা, উচ্চমান, উচ্চ চেতনার প্রতি। তাঁর অনুরক্তি ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং একেবারে প্রান্তিক মানুষদের জন্য।

প্রান্তিকতার বিনির্মাণের বেলায়ও কিন্তু নিমাই ভট্টাচার্য এমন কোনো চরিত্রকে, এমন কোনো বিধি ব্যবস্থাকে উপস্থাপিত করেননি, যার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তাই নিমাই ভট্টাচার্যের কোনো সৃষ্টিকেও কল্পিত এক ধরনের ইউটোপিয়ার পরিচায়ক হিসেবে ধরে নিতে পারি না। সহজ সরল বাস্তবতার মধ্যে, প্রখর রাজনৈতিক অথচ কোনো প্রকারের দলীয় আনুগত্য নয়, কিন্তু আদর্শবাদের প্রতি অনুরাগ, মনুষ্যত্বের প্রতি অনুরাগ, পরধর্মসহিষ্ণুতা, প্রীতি, ভালোবাসা, সম্প্রীতির জন্য আকুতি ছিল তাঁর সৃষ্টির সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য।

এই বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা যখন বাংলা সাহিত্যের প্রবাহিত স্রোতোপথকে ক্রমশ একধরনের বধ্যভূমিতে আবদ্ধ করে ফেলছে, এই রকম এক অন্ধকার সময়ে নিমাই ভট্টাচার্য আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের সঙ্গে বাংলার মেধা মননশীলতার সম্পর্কের সুতোগুলো প্রায় শেষ হয়ে আসতে বসেছে এখন। নিমাই ভট্টাচার্যের মতো মানুষ, তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টির মধ্যে, বিশ্বমানব হওয়ার তাগিদে, বাঙালিকে শাশ্বত চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার একজন শক্তিশালী কারিগর হিসেবে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, তথা বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

গৌতম রায়: পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও ইতিহাসবিদ।