Thank you for trying Sticky AMP!!

লিবিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশিদের জীবন

রয়টার্স ফাইল ছবি

২০১১ সালে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল আট মাস ছয় দিন। এ বছরের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে শুরু হওয়া রাজধানী ত্রিপোলি দখলের যুদ্ধ গত সপ্তাহে সেই সময়সীমাকেও অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু এখনো এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে দীর্ঘ অচলাবস্থার পর গত সপ্তাহে যুদ্ধ গতি পেয়েছে। শহরের উপকণ্ঠ ছাড়িয়ে যুদ্ধ এখন এগিয়ে আসছে ত্রিপোলির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর দিকে, যে এলাকাগুলোতে লিবিয়ানদের পাশাপাশি প্রচুর বাংলাদেশিও বসবাস করেন।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীপ্রধান ফিল্ড মার্শাল খালিফা হাফতার গত মঙ্গলবার ঘোষণা করেছেন, নতুন বছরের আগেই তিনি ত্রিপোলি জয় করবেন। হাফতারের এ ধরনের দাবি অবশ্য নতুন নয়। এ বছরের এপ্রিল মাসে তিনি যখন প্রথম ত্রিপোলি দখলের জন্য অভিযান শুরু করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর আন্তর্জাতিক মিত্রদের সমর্থন আদায় করেছিলেন এই আশ্বাস দিয়ে যে এটি হবে খুবই সংক্ষিপ্ত একটি অভিযান। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ রাজধানী তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

কিন্তু এরপর আট মাস পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রথম দু-তিন দিনেই অবশ্য তাঁর বাহিনী রাজধানীর কেন্দ্র থেকে মাত্র ৩০-৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছিল। কিন্তু এরপর যত দিন গেছে, কেবল একটা ফ্রন্ট বাদে বাকি সব ফ্রন্ট থেকে তাঁর বাহিনীকে উল্টো আরও পিছিয়ে যেতে হয়েছে। দীর্ঘ আট মাস পর গত সপ্তাহেই কেবল তাঁর বাহিনী নতুন করে সাময়িকভাবে কিছুটা অগ্রগতি লাভ করেছিল। এবং তাদের এই অগ্রগতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ত্রিপোলির অধিবাসীদের জন্য।

ত্রিপোলির সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকা হচ্ছে আল-হাদবা আল-খাদরা। বাংলাদেশ দূতাবাস এবং লিবিয়ার একমাত্র বাংলাদেশি স্কুল এই এলাকাতেই অবস্থিত। এবং সংগত কারণেই যে অল্প কিছু বাংলাদেশি পরিবার এখনো ত্রিপোলিতে আছে, তাদের একটা বড় অংশই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর সুবিধার জন্য এই এলাকাকেই বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছে।

হাদবা এলাকাটির অবস্থান ত্রিপোলির দক্ষিণে। ফিল্ড মার্শাল খালিফা হাফতারের বাহিনী প্রধানত দক্ষিণ দিক দিয়েই এগোনোর চেষ্টা করছে। সবচেয়ে কাছের যে ফ্রন্ট লাইনটি, তার অবস্থান হাদবা থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে। কয়েক দিন পরপরই যখন এই ফ্রন্টে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হয়, তখন হাদবার বাংলাদেশিরা তাঁদের ঘর থেকেই মেশিনগান এবং অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানের আওয়াজ শুনতে পান।

২ ডিসেম্বর ছিল বিশেষ করে বেশি ভয়াবহ। সেদিন সকাল থেকেই এত বেশি গোলাগুলির আওয়াজ আসছিল যে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ কমিউনিটি স্কুল ও কলেজ তাদের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয়। পরে বাংলাদেশ দূতাবাস ভবনের বেসমেন্টে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এর কয়েক দিন পরই ডিসেম্বরের ৭ তারিখে হাদবার আরেকটু দক্ষিণে আইনজারা নামের একটি এলাকার পরিস্থিতি এতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানকার লিবিয়ানদের দেখাদেখি একটি বাংলাদেশি পরিবারও তাদের বাসা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

এপ্রিল মাসে যখন প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন থেকেই যুদ্ধকবলিত এলাকাগুলো থেকে মানুষের পলায়ন শুরু হয়েছিল। এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে স্থানান্তরিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। লিবীয় মানুষের পাশাপাশি এঁদের মধ্যে আছেন প্রায় সাত শ বাংলাদেশি শ্রমিকও। এঁদের অনেকেই নিজেরা বেরিয়ে এসেছেন, আবার আটকে পড়া অনেককে লিবিয়ান রেড ক্রিসেন্ট এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয় করে বের করে এনেছে।

যুদ্ধকবলিত এলাকা থেকে বেরিয়ে আসা অনেকেই অন্যান্য এলাকায় গিয়ে পরিচিত বন্ধুবান্ধবের বাসায় উঠেছেন, অনেকে তাঁদের নিয়োগকর্তাদের আশ্রয়ে গিয়ে উঠেছেন। আর যাঁদের একেবারেই যাওয়ার মতো জায়গা ছিল না, এ রকম কিছু শ্রমিককে বাংলাদেশ দূতাবাসও অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বেরিয়ে আসা কর্মসংস্থান এবং আশ্রয়হীন এই শ্রমিকদের মধ্য থেকে প্রায় প্রায় আড়াই শর মতো গত কয়েক মাসে দূতাবাসের সহায়তায় আইওএমের মাধ্যমে দেশে ফিরে গেছেন।

ত্রিপোলিতে বসবাসরত প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশি প্রবাসীর তুলনায় এই সংখ্যাটি খুব বেশি নয়। যুদ্ধ সত্ত্বেও অধিকাংশ বাংলাদেশিই এখনো দেশে ফিরতে কিংবা ত্রিপোলি ছাড়তে ইচ্ছুক নন। কারণ, ত্রিপোলির দক্ষিণে ফ্রন্ট লাইনের আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পরিস্থিতি বসবাসের অযোগ্য হলেও রাজধানীর কেন্দ্রে জীবনযাত্রা এখনো একেবারেই স্বাভাবিক। শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাটে মানুষের ভিড় দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই, মাত্র ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরেই কী ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে!

নতুন করে অবৈধভাবে যেসব বাংলাদেশি লিবিয়ায় আসছেন, তাঁদের জন্য লিবিয়া এখন খুবই কঠিন একটি জায়গা। কিন্তু যাঁরা ১০–১৫ বছর কিংবা আরও বেশি সময় লিবিয়ায় অবস্থান করছেন, তাঁরা এখানকার জীবনযাপনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের অনেকেই নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে কিংবা বকেয়া বেতন ফেলে দেশে গিয়ে নতুন করে জীবিকা অন্বেষণে আগ্রহী নন।

তাঁদের অনেকেরই মনোভাব এ রকম, যুদ্ধ যে সহসাই শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আট মাস ধরে যুদ্ধ চলার পরও যেহেতু শহরের ভেতরে তার প্রভাব পড়েনি, হয়তো আরও বছরখানেক চললেও পরিস্থিতি একই রকম থাকতে পারে। তা ছাড়া ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত লিবিয়াতে কখনোই একই সঙ্গে খুব বেশি এলাকায় যুদ্ধ চলেনি। এক এলাকার পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে সেখানকার লিবিয়ানরা যখন বেরিয়ে যাবে, তখন তাদের সঙ্গে বেরিয়ে অন্য এলাকায় চলে যাওয়া যাবে।

হাদবা এলাকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেও একই মনোভাব লক্ষ করা যায়। তাঁদের অনেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত আছেন, পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হলে অন্য কোনো শহরে বা অন্তত অন্য কোনো এলাকায় চলে যাবেন। কিন্তু কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও এখনই তাঁরা লিবিয়া ছাড়তে চান না। লিবিয়ানদের অনেকের মতোই তাঁরা এখনো আশাবাদী, যুদ্ধ হয়তো ত্রিপোলির ভেতরে প্রবেশ করবে না। তার আগেই যেকোনো একটা পক্ষ জিতে যাবে।

২০১১ সালে প্রায় সমগ্র লিবিয়ায় যুদ্ধ হলেও ত্রিপোলিতে বলতে গেলে কোনো যুদ্ধই হয়নি। ত্রিপোলির জনগণ আট মাস নিশ্চুপ থাকলেও বিদ্রোহীরা কাছাকাছি আসামাত্রই তাদের অনেকে সুযোগ বুঝে ভেতর থেকে বিদ্রোহ করে বসেছিল। সেই সঙ্গে ওপর থেকে ন্যাটোর বিমান হামলা গাদ্দাফির সেনাবাহিনীকে কোনো প্রতিরোধ করার সুযোগই দেয়নি। ফলে এক রাতের মধ্যেই প্রায় বিনা যুদ্ধে ত্রিপোলির পতন ঘটে গিয়েছিল।

অনেকেরই আশা, এবারও হয়তো সে রকমই কিছুই ঘটবে। ত্রিপোলি ধ্বংস হওয়ার আগেই যেকোনো এক পক্ষ জিতে যাবে। কিন্তু আরব আমিরাত, মিসর, জর্ডান, ফ্রান্স, রাশিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র যেভাবে একের পর এক অস্ত্রশস্ত্র, ড্রোন এবং সৈন্য নিয়ে লিবিয়ার এই প্রক্সি যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে, তাতে এই আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ আছে, এবার হয়তো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে না। দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত হয়তো সবাইকেই ত্রিপোলি ছাড়তে হবে।

মোজাম্মেল হোসেন: লেখক, লিবিয়ায় কর্মরত পুরপ্রকৌশলী
tohamh@gmail.com