Thank you for trying Sticky AMP!!

অন্য এক ১৪ ফেব্রুয়ারি বা ভালোবাসার কথা

রাজা দ্বিতীয় ক্লাউদিয়াসের ধারণা ছিল, যারা প্রেম করে বা ভালোবাসে মানুষকে, তারা যুদ্ধবিগ্রহের ধারেকাছে ঘেঁষে না, তাই তো যুদ্ধে যাওয়ার লোক মেলে না। অতএব যুবকদের প্রেম-বিয়ে সব নিষিদ্ধ। সাধু ভ্যালেন্টাইন গোপনে প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিয়ে পড়িয়ে দিতেন, তাই ক্লাউদিয়াসের আদেশে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ঘটনাটা যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার ২৭০ বছর পর কোনো এক ১৪ ফেব্রুয়ারির। ব্যস, বেজে উঠল বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের সেতার। ইতিহাস এযাবৎ এ রকমই সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে।

বলা বাহুল্য, ক্লাউদিয়াসের আশা পূরণ হয়নি, তবে বাজার অর্থনীতি মুনাফা তৈরির একটা মওকা পেয়েছে। এই জব্বর উপলক্ষ করপোরেট দুনিয়া কী করে হাতছাড়া করে? মোবাইলে, ই-মেইলে হরদম অফার আসছে কম খরচে সঙ্গীসহ অসম্ভব জায়গায় রাতযাপন থেকে সস্তায় যা খুশি তা–ই খাওয়ার। ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারির কোনো সাক্ষী নেই। কেউ দেখেনি সে ঘটনা, তবু মানুষ ভালোবাসায় মোড়াতে চায় জীবনকে। হোক না তা দিবস উদ্‌যাপনের বাহানায়। তবে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি যাঁরা ঢাকায় প্রতিবাদ করেছিলেন দেশকে আর গণতন্ত্রকে ভালোবেসে, তাঁদের কাছে ১৪ ফেব্রুয়ারি মানে রক্ত দিয়ে ভালোবাসার ঋণ শোধের অঙ্গীকার।

সেদিনও ছিল ভালোবাসা দিবস, ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তখনকার ১১টি প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয়। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী আকাশকাঁপানো স্লোগানে নেমে আসেন রাজপথে। তাঁদের বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন মায়ের কোলে। তবে মা-বাবার গর্জে ওঠার স্মৃতি, বড় ভাইদের সশস্ত্র প্রতিরোধের দোলা তাঁদের রক্তেও ছিল।

শুরু হয়েছিল কলা ভবনের বটতলা থেকে। সকাল ১০টা বাজার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন হল, ঢাকা শহর এবং আশপাশের এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। মিছিল যাবে সচিবালয়, শিক্ষা ভবন। মিছিলে কেউ যাতে কোনো রকম হঠকারিতা করে না বসেন, সেদিকে কঠোর নজর রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট ১১টি ছাত্রসংগঠনের প্রতিটি থেকে সমানসংখ্যক ছাত্রনেতার সমন্বয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী টিম গঠন করা হয়েছিল। প্রথম থেকেই সামরিক শাসকের এজেন্টরা চতুর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ভেতর থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি আর নাশকতার চক্রান্তে মেতেছিল। তাই এই সাবধানতা। ১১ ছাত্রসংগঠনের ১১০ ছাত্রনেতার কঠিন নজরদারিতে এক অভূতপূর্ব সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় যেন বাঁধভাঙা স্রোতের গতিতে এগিয়ে চলে মিছিল। মিছিল টিএসসি, পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলা একাডেমি, পুষ্টি ভবন পেরিয়ে দোয়েল চত্বর পৌঁছাতেই কার্জন হল সায়েন্স এনেক্স থেকে আরও অনেক ছাত্রছাত্রী যোগ দেন সেই মিছিলে। কার্জন হল আর শিশু একাডেমীর মাঝামাঝি রাস্তায় মিছিল গণমিছিলের রূপ নেয়। মিছিলের বেগে মিছিল শিক্ষা ভবনের অনেকটা কাছাকাছি চলে যায়। শিক্ষা ভবন থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত তখন ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড এলাকাজুড়ে শত শত দাঙ্গা পুলিশ আর সাঁজোয়া গাড়ির বহর।

ক্রুশবিদ্ধ যিশুর রক্ত ঝরার ১৯৮৩ বছর পর একই তারিখে দেশপ্রেমে পাগল একদল তরুণ-তরুণীকে প্রকাশ্য রাস্তায় খুন করার আদেশ দিয়েছিল ক্লাউদিয়াসের প্রেতাত্মার উর্দিপরা বাঙালি রাজারা। বিনা উসকানিতে অতর্কিতে তারা মিছিলকারীদের ওপর প্রথমে কাঁদানে গ্যাসের শেল, পরে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। সে ছিল এক জীবন্ত চাঁদমারি উদ্‌যাপন। স্বাধীন দেশের মাটিতে স্বাধীন দেশের বাহিনীর হাতে প্রকাশ্য রাজপথে দিনদুপুরে প্রথম একজন নারী—দীপালি সাহা—খুন হলেন। আমার বিশ্বাস, সেদিন যাঁরা মিছিলে ছিলেন বা দূর থেকে মজা দেখছিলেন অথবা পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাঁরা আজও ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বীভৎস গুলির আওয়াজই শোনেন। দীপালি সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব আর কাঞ্চনের নাম শুধু মৃতের শেষ তালিকায় পাওয়া যায়। বাকিদের নাম আজও জানা যায়নি। সেদিন যাঁরা মিছিলে ছিলেন, তাঁরা কেউ বিশ্বাস করেন না নিহত হওয়ার এই তালিকা।

দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণীরা সব অর্থেই নিরস্ত্র ছিলেন, তাঁরা শুধু তাঁদের দেশের প্রতি ভালোবাসার চেতনায় উজ্জীবিত যৌবনের গান গেয়ে সেদিন পথে নেমেছিলেন। নিহত ব্যক্তিদের একটা সহি তালিকা কি আমরা দাবি করতে পারি না?

আজ, কাল কিংবা পরশু যাঁরা ক্ষমতার গোশত-রুটি ভাগ-বাঁটোয়ারা করেছেন, করছেন, করবেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, কাদের রক্তনদীর ফল তাঁরা ভোগ করছেন। কীভাবে তোপখানায় পড়া দীপালিদের রক্ত টিএসসির সড়কদ্বীপ পেরিয়ে লাইব্রেরির সামনে এসে মিলনের রক্তে মেশে। পতন হয় স্বৈরাচার ক্লাউদিয়াসের প্রেতাত্মাদের।

কেন সাত বছর লেগে যায় রক্তনদীর এটুকু পথ আসতে, তা-ও তাঁদের জানা। দীপালিদের রক্তের সঙ্গে মেশে ৯০-এর ইব্রাহিম-দেলোয়ারের রক্তনদীর ধারা; তীব্রতর হয়, জয় হয়, কিন্তু ষড়যন্ত্র চলে। রক্ত ঢালেন রউফন বসুনিয়া নীলক্ষেতে, নূর হোসেন জিরো পয়েন্টে তারপর ডা. মিলন। দৃশ্যত মুক্তি। কিন্তু রক্তঋণ অস্বীকার করলে যে মুক্তি মেলে না, তা বাংলার মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে কালে কালে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সে রকমই রক্তঋণ রেখে গেছে বাংলার তরুণ-তরুণী আর যুবাদের কাছে, যাঁরা ভালোবাসার জন্য সবকিছু বাজি রাখতে পারেন।

স্বৈরাচার গোষ্ঠীর পতনের পর যাঁরাই ক্ষমতার কুরসি, মোড়া, টুল বা পাটিতে বসার সুযোগ পেয়েছেন অথবা সুযোগের শিকের দিকে তাকিয়ে আছেন, তাঁদের কেউই দীপালিদের কথা মনে রাখেননি। কতিপয় বামপন্থী দল হয়তো দায়সারা একটা সভা করে প্রেসনোট পাঠায়। পাঠক আছে—এমন দৈনিকের শিরোনাম থেকে খসে গেছে দীপালিদের নাম। এভাবেই আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’-এর কথা। কী হয়, যদি আমরা বাজার অর্থনীতি মেনে নিয়ে আমাদের ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটু অন্যভাবে উদ্‌যাপন করি। কী হয়, এদিন যদি আমাদের সব পরিচিত নারী, মা, বন্ধু, কন্যা, সহকর্মীদের অনুমতি নিয়ে দীপালি বলে ডাকি আর প্রিয় পুরুষটিকে এদিন ভালোবেসে ডাকি বসুনিয়া, রউফন, সেলিম, দেলোয়ার, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল বা কাঞ্চন নামে। সারা শহর মাতিয়ে মিছিল করার সেই সোনালি ছাত্র আন্দোলনের দিন না থাকলেও শাহবাগ এখনো মুখ ফেরায়নি। কী হয়, যদি শাহবাগের সব ফুলের দোকানের নাম কাল থেকে হয়ে যায় দীপালি, বসুনিয়া, রউফুন, সেলিম, দেলোয়ার, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চন বা আইয়ুব। এতে রক্তঋণ শোধ হবে না, কিন্তু নামগুলো অন্তত হারাবে না। জানি না, দেলোয়ারের বাবা এখনো বেঁচে আছেন কি না। কতখানি বুকের পাটা থাকলে এরশাদের দেওয়া ৫০ হাজার টাকা না ছুঁয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারেন কলিজার টুকরা হারানো সেই বাবা। সেলিম, দেলোয়ারের নামে তৈরি ভান্ডারিয়ার সেই শহীদ মিনারের কী খবর?

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক