Thank you for trying Sticky AMP!!

অযথা শব্দ আর কত?

দিনটি শুক্রবার ছিল। রাস্তা খালি দেখে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে গাড়ির হর্নের বিকট শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রায় ১০০ গজ দূর থেকে একটি গাড়ি হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে এসে আমাকে পেরিয়ে চলে গেল। অথচ পুরো রাস্তা প্রায় খালিই ছিল।

কারণে–অকারণে হর্ন বাজানোর প্রবণতা বেড়েছে। এমনকি ফাঁকা রাস্তায়ও। সে জন্য অন্যের কান ঝালাপালা হলেও যেন কিছু এসে যায় না। কিন্তু এতে ক্ষতি দুই পক্ষেরই।সাধারণ মোটরসাইকেলে লাগানো হয়েছে ভারী যানবাহনের জন্য তৈরি হর্ন।

শব্দ দূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে; শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, সারা দেশেই। সম্প্রতি গিয়েছিলাম এক বিভাগীয় শহরে। সেখানে একটু যানজট বাঁধলেই চারপাশ থেকে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করল সব ধরনের যানবাহন। যেন শুধু হর্ন দিলেই জট ছুটে যাবে। শেষে জট খুলতে নির্ধারিত সময় লাগলই, মাঝখান থেকে জটে বসে থাকা মানুষগুলোর কানের বারোটা বাজল।

শব্দ দূষণের উৎস শুধু যানবাহন নয়। উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিয়েই বাড়ি-ঘরের নির্মাণ কাজের শব্দ, উচ্চস্বরে মাইক বাজানো, লাউড স্পিকারে ধুন্ধুমার গান চালিয়ে রাত–বিরাতে পাড়া-প্রতিবেশির কানা ঝালাপালা করাও দৈনন্দিন ঘটছে। আমরা নিজেরা এ নিয়ে কতটা উদাসীন, তার একটি উদাহরণ দিই। আমার এক সুহৃদ সেদিন বলছিলেন, কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই তাঁর পাশের বাসায় সম্প্রতি টাইলস কাটা হচ্ছিল। তাঁর কয়েক বছর বয়সী মেয়ে সেই কর্কশ শব্দে অস্থির হয়ে পড়লে তিনি শব্দ কমাতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু যে দেশে শুকনো কথায় চিঁড়ে ভেজে না, সেখানে কি আর অনুরোধ-উপরোধে শব্দের দূষণ কমবে? টাইলস কাটার নির্দেশদাতা ব্যক্তির তাই মন গলেনি। শব্দের অত্যাচার চলছিল, চলছিল ছোট্ট শিশুটির যন্ত্রণাও।

উচ্চ শব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা সব বয়সের মানুষেই দেখা দিতে পারে। তবে বিশেষভাবে ক্ষতি হতে পারে শিশুদের।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দেশের প্রশাসনিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত সচিবালয়ও শব্দ দূষণের শিকার। প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত ২১ ডিসেম্বর সচিবালয়–সংলগ্ন জিরো পয়েন্ট মোড়ে বসানো একটি সাউন্ড প্রেশার লেভেল (এসপিএল) মিটারে ওই স্থানের শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১২৮ দশমিক ৬ ডেসিবল।

অথচ শব্দদূষণ বিধি অনুযায়ী, নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত সচিবালয়ের ওই স্থানের শব্দের মাত্রা থাকার কথা ৫০ ডেসিবল।

সচিবালয় এলাকায় হর্ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে গত বছর। একে নীরব এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এক বছরে কতটা উন্নতি হয়েছে, তা তো ডেসিবলের হিসাবেই স্পষ্ট। সচিবালয়ের অবস্থাই যদি এমন হয়, তাহলে সারা দেশে কী অবস্থা ভাবুন একবার!

এ থেকে অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আমরা শব্দের দূষণকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। পরিবেশের অন্যান্য দূষণ নিরাময়েও আমাদের সচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের প্রতিরোধ কার্যক্রম অবশ্য জোরালো নয়। শব্দ দূষণে আমাদের অবহেলা আরও বেশি।

স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবল বা তার বেশি হলেই তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেল, উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

ফলে অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। উচ্চ শব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা সব বয়সের মানুষেই দেখা দিতে পারে। তবে বিশেষভাবে ক্ষতি হতে পারে শিশুদের। দিনের পর দিন শব্দ দূষণের শিকার শিশুদের মনোযোগ দেওয়ার ও কিছু পড়ার ক্ষমতা লোপ পেতে পারে।

অথচ এ দেশে ২০০৬ সাল থেকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা আছে। এই বিধিমালা অনুযায়ী শব্দ দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু তা আসলে কতটুকু কার্যকর? উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলে আজ হয়তো শব্দ দূষণ এত মারাত্মক হয়ে উঠত না।

এ বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই, তবে কোনো আইন দিয়েই শব্দ দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে না। আমাদেরকেই বুঝতে হবে যে, অহেতুক শব্দ সৃষ্টি আমাদের সকলের জন্য ক্ষতিকর। একবার ভেবে দেখুন, রাস্তায় আপনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো যান যদি পিলে চমকানো হর্ন দেয়, তবে কি বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে যায়? এবার দয়া করে সেই বিরক্তিকেই আমলে নিন। নিজে অহেতুক শব্দ সৃষ্টির সময় সেই বিরক্তির কথা মনে করুন, আশপাশের সবার কথা ভাবুন। তাতে যদি আমাদের অযথা শব্দ উৎপাদন কিছুটা হলেও কমে।

অর্ণব সান্যাল: লেখক ও সাংবাদিক
arnab.sanyal@prothomalo. com