অর্থনীতি কি একটু ঝিমিয়ে পড়েছে?
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি ঝলমলে চিত্র এঁকেছে। গত মাসের শেষ দিকে এশিয়ার অর্থনীতির আগামী দিনের গতি-প্রকৃতির পূর্বাভাসসংবলিত এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ২০২০ সালে এশিয়ায় সর্বোচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ হবে বাংলাদেশ। এডিবি মনে করছে, চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ হবে। আর তা সম্ভব হবে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জোরালো সরকারি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের উচ্চ প্রবাহের কারণে।
চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়নবিষয়ক যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে অবশ্য বলা হয়েছে যে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। একদিকে দেশের ভেতরে আর্থিক খাতে সুশাসনের প্রবল ঘাটতি, কর-রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা ও রপ্তানিতে শ্লথগতি, অন্যদিকে চীন-আমেরিকা শুল্কযুদ্ধের ফলে বিশ্ববাণিজ্যে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা। এসব কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। পৃথক আরেক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক এ–ও বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় এবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ হবে বাংলাদেশ। প্রথম স্থানে থাকবে ভুটান, ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি নিয়ে।
অন্যদিকে গত সপ্তাহের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে এই আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে চলতি অর্থবছর ৮ দশমিক ২০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে এবং মূল্যস্ফীতির হার লক্ষ্যমাত্রার (৫ দশমিক ৫০ শতাংশ) নিচে থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই আশাবাদ অনেকটাই শর্তসাপেক্ষ। সংস্থাটির মতে, দেশের বাইরে বেড়ে চলা বাণিজ্যযুদ্ধ, ব্রেক্সিট (ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা) নিয়ে অনিশ্চয়তা, বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথগতি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার বিস্তার উচ্চতর প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আবার দেশের ভেতরে বাধা তৈরি করতে পারে উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং তারল্যসংকট।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে কি করবে না, তা দেশি-বিদেশি একাধিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। অবশ্য এই নির্ভরশীলতার বিষয়টি কমবেশি প্রতিবছরের জন্যই প্রযোজ্য। তাই বলে এটাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই, বরং পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শেষ হওয়ার পর এই সময়ে চলতি অর্থবছরের হাল কী দাঁড়িয়েছে।
মুশকিল হলো, এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ কোনো চিত্র এখনো পাওয়া সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সূচকের যেটুকু তথ্য-উপাত্ত মিলছে, তাতে মনে হয়, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা ধীরগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। রপ্তানি আয় দিয়েই দেখা যাক। জুলাই-সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ কমেছে। অবশ্য বিশ্বজুড়েই পণ্য রপ্তানি ও আমদানিতে এখন একধরনের মন্দাভাব চলছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) আভাস দিয়েছে, এ বছর শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্য মাত্র ১ দশমিক ২০ শতাংশ হারে বাড়তে পারে। বছরের অর্ধেকটা পেরিয়ে বিশ্ববাণিজ্য মাত্র দশমিক ৬০ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই সময়ে এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বিত রপ্তানি বেড়েছে মাত্র দশমিক ৭০ শতাংশ হারে। বিপরীতে পণ্য আমদানি কমেছে দশমিক ৪০ শতাংশ হারে।
সুতরাং অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের বৈশ্বিক রপ্তানি যে কিছুটা স্তিমিত হয়েছে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তবে জুলাই-আগস্ট সময়ে আমদানি ব্যয়ও কমেছে প্রায় আড়াই শতাংশ। এতে সাময়িক একটা লাভ হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে, চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত অবস্থা দেখা দিয়েছে। সহজভাবে বললে আয়ের তুলনায় ব্যয় কম হচ্ছে। আবার আমদানি কমে যাওয়া ইঙ্গিত করে যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় কিছুটা গতি হারিয়েছে, দেশের ভেতরে সার্বিক চাহিদা খানিকটা কমেছে। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির হার আগস্ট মাসে ১০ দশমিক ৬২ শতাংশে নেমে আসা (যা গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন) কিংবা ব্যাংকের সার্বিক ঋণপ্রবাহ জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে মাত্র দশমিক ৪০ শতাংশ হারে বাড়া এই ধারণাকে একটু জোরালো করে বৈকি।
তারপরও এই গতি বা চাহিদা কমে যাওয়ার মাত্রা কতখানি, তা সঠিকভাবে জানার প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আপাতত পুরোপুরি মিলছে না। যেসব সূচক একটা স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারত, সেগুলো নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। মাঝারি থেকে বৃহৎ শিল্পের উৎপাদন সূচক (কিউআইআইপি) প্রতি মাসে প্রকাশিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জুন মাসের পর আর এটি প্রকাশ করেনি। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ওয়েবসাইটে ২০১৮-এর পর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের কোনো হালনাগাদ পরিসংখ্যানও মেলে না। এমতাবস্থায় এটাও খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না যে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়ছে। আর যদি ঝিমিয়েও পড়ে, আগামী দিনে তা কাটিয়ে ওঠার ও উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের সামর্থ্য ও সম্ভাবনাও আছে যথেষ্ট, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
অর্থাৎ অর্থনীতির গতিময়তা অনুধাবন করা কঠিন হচ্ছে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্তের অভাবে। দৃশ্যত যা–ই দেখা যাক না কেন, তা যদি সময়মতো ও ঠিকভাবে পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত না হয়, তাহলে একধরনের বিভ্রান্তি বা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে ছুটতে থাকার কালে এ রকম অবস্থা প্রত্যাশিত নয়।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক
asjadulk@gmail.com
আরও পড়ুন
-
ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে যে বদল এসেছে
-
আইসিইউর এসি নষ্ট, অস্ত্রোপচারও বন্ধ, কষ্টে রোগীরা
-
দিনাজপুরে ভোট গণনার পর দুই প্রার্থীর সমর্থকদের উত্তেজনা, পুলিশের গুলিতে নিহত ১
-
এবার ‘কিপটে’ মোস্তাফিজের ২ উইকেট, বড় জয়ে শীর্ষ তিনে ফিরল চেন্নাই
-
ঢাকাসহ ৫ জেলা: মাধ্যমিক সোমবার বন্ধ হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলাই থাকছে