Thank you for trying Sticky AMP!!

অর্থনৈতিক কাঠামোতে সংস্কার দরকার

পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে—গেল ১০ বছরে দেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি বেরিয়ে গেছে। গড়ে বছরে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা।  দেশের সাধারণ মানুষ বিদেশে অর্থ স্থানান্তরের কারণ হিসেবে অবৈধভাবে টাকার লেনদেন, পুঁজি পাচার, রাজনৈতিক দুর্নীতি বৃদ্ধি, মানি লন্ডারিং, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা, দুর্বল শাসন এমনকি আন্তসীমান্ত বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেন। 

সংশ্লিষ্ট সবাই যথার্থই মনে করেন, এটি অনেক বড় ইস্যু এবং শিগগিরই এই ইস্যুর একটি বিহিত করা জরুরি। অনেকে মনে করেন, এ ক্ষেত্রে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও সজাগ হওয়া দরকার। কেউ কেউ মনে করেন, দেশে আইনের শাসন ও অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এমন প্রবণতা কমবে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, যেহেতু বর্তমান সরকার দুর্নীতিবিরোধী স্ক্যানারের অধীনে নিজস্ব রাজনৈতিক দলের কিছু আইনপ্রণেতাকে আনতে পেরেছে, সেহেতু তারা এটি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগও নিতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীও সাম্প্রতিক বিভিন্ন আলোচনায়ও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। 

এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার অনেক দেশে কাজ করার সুবাদে আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে বিদেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের উল্লিখিত টাকার কয়েক গুণ বেশি বা ন্যূনতম সমপরিমাণ আমানত রয়েছে। অনেক বাংলাদেশিরই প্রচুর অর্থ সিঙ্গাপুর, দুবাই, হংকং, লন্ডন, টরন্টো কিংবা ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জগুলোর ব্যাংকে রাখার সামর্থ্য আছে। অন্য অনেক উন্নয়নশীল অর্থনীতির মতো দেশে কালো বা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির বৃহৎ আকার, দুর্বল সুশাসন, জবাবদিহির অভাব, রাজনৈতিক আনুকূল্যে দুর্নীতি, অস্পষ্ট অথবা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে কড়াকড়ি বিধির কারণে সাদা বা আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির ৩০-৮০ শতাংশ হলো কালো বা ছায়া অর্থনীতি। অতীতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় পাকিস্তানের ব্যক্তি আমানতকারীদের সঞ্চয়, ইউরোপীয় ব্যাংকগুলোয় ভারতীয় আমানত, সিঙ্গাপুরের ব্যাংকগুলোয় ইন্দোনেশীয় আমানত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোয় আফ্রিকার স্বৈরশাসকদের আমানত এ ক্ষেত্রে বহু সাক্ষ্য বহন করে। 

প্রকৃতপক্ষে এর ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলোয় পুরো ‘প্রাইভেট ব্যাংকিং’ অথবা ‘ব্যক্তিসম্পদ ব্যবস্থাপনা’ ব্যবসা বিকাশ লাভ করেছে। ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কিংবা তার ওপর আমানত রাখা ব্যক্তি বা পরিবারগুলোকে এসব ব্যাংক ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ এবং ‘আউট অব দ্য ওয়ে’ সেবা িদয়ে আসছে। এদের জন্য এসব সম্পদ ব্যবস্থাপকের পক্ষ থেকে ট্রাস্টি সেবা, দেশে-বিদেশে উচ্চমানের সম্পদ কেনা, বিরল চিত্রকর্ম ক্রয়, নীল নদের দেশ কিংবা ক্যারিবীয় অঞ্চল ভ্রমণের সুযোগ, বিশ্বকাপ ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলা দেখা, সর্বোপরি উচ্চমার্গীয় থিয়েটারে নাটক বা মুভি দেখানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। সব সময় এসব সুবিধা কেবল কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক বা সামরিক-বেসামরিক আমলা যে পান তা নয়; আমি নিশ্চিত, আমাদের দেশের বেশ কিছু ব্যবসায়ীও এসব সেবা গ্রহণের স্ট্যাটাস অর্জন করেছেন। 

আপনি ঢাকা শহরের কোনো অভিজাত এলাকায় বিয়ে কিংবা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলে শুনবেন, ১০-১৫ শতাংশ মানুষ সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা অথবা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত পাসপোর্ট বা আবাসিক কিংবা রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস উপভোগ করছেন। এর সমান্তরালে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় প্রতিনিয়ত বাংলাদেশি নাগরিকদের নির্বাহী হিসেবে চাকরি করার সংখ্যাও বাড়ছে। তাদের কোনোভাবেই বিশ্বের যেকোনো ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় অথবা বাইরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কথা নয়। এযাবৎ কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়নি, বাংলাদেশ থেকে কীভাবে এসব বাংলাদেশি বৃহৎ আমানতকারী বাইরে টাকা নিয়ে যান।

বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাইরে শিক্ষা অর্জন, বেড়ানো অথবা কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। সন্তানদের কল্যাণে বাংলাদেশি পিতা-মাতারা বাইরে যাওয়ার জন্য অভিবাসী বা অ-অভিবাসী ভিসার জন্য উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় দূতাবাসগুলোয় লাইন ধরছেন। প্রতিবছর এ লাইন দীর্ঘতর হচ্ছে। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্দেশীয় অর্থনীতির আকার তার প্রায় ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিক লেনদেনের বাধ্যবাধকতা পূরণে টাকার ‘সহজ প্রবাহ’ এবং অধিকতর গুরুত্বসহকারে আন্তর্জাতিক বাজারে অংশগ্রহণ থেকে মুনাফা অর্জন প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সংগত কারণেই বাইরে টাকা লেনদেনের সুযোগ করে দেয় না। বৈশ্বিক জোগানব্যবস্থায় গভীর সম্পৃক্ততা অথবা আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জনের জন্য বৃহৎ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে অধিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের ব্যবসায়িক লেনদেন ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে বাণিজ্যও বাড়ছে। বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বাইরে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের চেষ্টা করছেন। দেশের কিছু বৃহৎ পণ্য ব্যবসায়ী বৈশ্বিক পণ্য নিলাম বাজারে অংশগ্রহণের জন্য কার্যকর বাণিজ্য লাইন কিংবা ব্যাংকিং লাইন পেতে বিদেশি ব্যাংকগুলোয় রক্ষিত আমানতকে আংশিক জামানত হিসেবেও ব্যবহার করছেন। পণ্য স্পট মার্কেটে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভালো দর পেতে তাদের এটা প্রয়োজন। বাংলাদেশি ব্যাংকে এলসি খুলে তাঁরা এসব সুবিধা নিতে পারবেন না। 

২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত সরকারের সময়ে আর্থিক অপরাধ তদন্তকে সহজতর করার জন্য দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তাদের শক্তিশালী করতে প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করা হয়। সেই প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে একটি কেস এসেছিল, যেখানে দেখা যায়, কিছু বাংলাদেশি উদ্যোক্তা তাঁদের বাইরের ব্যাংক হিসাব থেকে বাংলাদেশে অবস্থিত একটি সুপ্রতিষ্ঠিত চা কোম্পানির কিছু বাগান কেনার ব্যয় মেটাতে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠিয়েছিলেন। সে সময় আমাকে একজন কর্নেল জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘স্যার, এটা কীভাবে ঘটল?’ প্রত্যুত্তরে আমি বলেছিলাম, ইউরোপীয় মালিকের কিছু ভালো মানের চা-বাগান বিক্রির প্রক্রিয়া চলছিল। কিছু বাংলাদেশি মালিক এই চা-বাগান কেনার আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করেছেন। তঁারা এসব চা-বাগানকে লাভজনকভাবে চালানোর দক্ষতাও অর্জন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচলিত বৈদেশিক বিনিময় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এটিকে অনুমোদন দিতে পারে না। আমি আরও বলেছিলাম, কর্নেল, আপনি যদি এসব ইউরোপীয় মালিকের স্থানীয় সম্পত্তি বাংলাদেশি মালিকদের কেনাতে চান, সে ক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? তিনি কিছুক্ষণ নীরব ছিলেন এবং তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রচলিত আইন ও বিধি এখনো বাংলাদেশে চর্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন।

আমরা যদি দেশকে এগিয়ে নিতে এবং দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি চাই, তাহলে অবশ্যই নীতিমালার ধারাবাহিক সংস্কারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক কাঠামোয় কার্যকর পরিবর্তন আনতে হবে; আমাদের সংশ্লিষ্ট নীতিমালাকে পরিবর্তিত ও পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলানো প্রয়োজন। দেশের ব্যবসায়িক সম্প্রদায়কে সহজতর পথে মুনাফা অর্জন করার সুযোগ দিয়ে জাতীয় সম্পদ সৃজনে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের অধিক হারে বৈশ্বিক জোগানব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার পাশাপাশি তারা যেন আন্তর্জাতিক বাজারের সাময়িক ওঠানামা থেকে অধিকতর লাভ নিশ্চিত করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়া কিংবা সরকারের উচ্চপর্যায়ের পদে বসে জনকল্যাণকে জলাঞ্জলি দিয়ে অবৈধ অর্থ অর্জনের পথ রুদ্ধ করতে হবে। অবশ্যই বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় তদারকি সংস্থাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য, করপোরেট করহার এবং বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনা বা নীতিমালাকে অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের প্রচলিত নীতিমালার আলোকে যুগোপযোগী করতে হবে। 


মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক