Thank you for trying Sticky AMP!!

অর্থনৈতিক সাফল্যের গোলকধাঁধা

ফিলিপাইনের ম্যানিলায় ৫১তম বার্ষিক সভায় এডিবির সভাপতি তোহাইকো নাকো বক্তব্য দেন

ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় ৫ মে শেষ হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৫১তম বার্ষিক সম্মেলন। ১৯৬৬ সালে এডিবি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক বছর পর থেকে প্রতিবছর এর পরিচালনা পরিষদের বার্ষিক সাধারণ সভার পাশাপাশি বিগত বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা এবং আগামীর করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে সদস্যদেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরেরা বৈঠকে মিলিত হন। একই সময়ে আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ও অন্যরা সমকালীন বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যা ও সেগুলো সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করে নানা রকম সুপারিশ পরিচালনা পরিষদের কাছে পেশ করেন।

এডিবির এবারের সম্মেলনে চার হাজারের বেশি প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন। সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা ছাড়াও ছিলেন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী নেতা ও সমাজের নেতৃস্থানীয় সদস্যরা। তাঁরা ম্যানিলায় তিন দিন ধরে নানা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন এবং স্বাগতিক দেশের আয়োজিত বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। তারপর দেশে ফিরে গিয়ে তাঁদের অনেকেই সম্ভবত অপেক্ষায় থাকবেন পরবর্তী সম্মেলনে আবারও যোগদানের আমন্ত্রণ পাওয়ার। এর একটি কারণ এ-জাতীয় আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক সম্মেলনের গঠনকাঠামোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

এবার নিয়ে মোট পাঁচবার এডিবির বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার হয়। প্রতিটি সম্মেলন প্রায় একই নিয়ম অনুসরণ করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং নতুনত্বের এই ঘাটতি সম্ভবত এই ইঙ্গিত দেয় যে সেখানে আলোচনাগুলো হয় আলোচনার খাতিরেই। আলোচনা থেকে উঠে আসা সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে, তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা তেমন থাকে না। ফলে সরকারি নেতাদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের একই প্রতিনিধিরা বছরের পর বছর ধরে এসব সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যোগ দিচ্ছেন এবং তারকা হিসেবে বিবেচিত টেলিভিশন ব্যক্তিত্বরা অর্থের বিনিময়ে অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

এবারের সম্মেলনে চোখে পড়ার মতো অনুপস্থিতি ছিল চীনের নেতৃত্বে গঠিত নতুন আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি)। মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা ছাড়া এই ব্যাংকের আর কাউকে দেখা যায়নি। অথচ এক বছর আগের সম্মেলনে এই ব্যাংকের প্রধান উপস্থিত ছিলেন এবং এডিবির প্রেসিডেন্ট সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করেছিলেন, আগামী দিনগুলোতে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তহবিলের জোগানদার এ দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে। এবারের সম্মেলনে তিনি অবশ্য বলেছেন যে এ পর্যন্ত চারটি প্রকল্পে দুই ব্যাংক সহযোগিতা করছে এবং আরও কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা চলছে। সহযোগিতা বাড়ার এই গতিকে দ্রুত বলা যায় না।

সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে অবশ্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত আঞ্চলিক অর্থনীতির অগ্রগতি ও সমস্যার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সম্মেলনে প্রতিনিধিরা আলোচনা করেছেন এবং সে রকম অধিকাংশ আলোচনাতেই এডিবির ঘোষিত ২০৩০ উন্নয়ন কৌশলে উল্লেখিত সমৃদ্ধ, সম্পৃক্ততামূলক, স্থিতিশীল ও টেকসই এশিয়া গড়ার লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।

সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত এডিবির ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের অর্থনীতির সার্বিক চিত্রে দেখা গেছে, এই অঞ্চলের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দিকগুলোর অন্যতম হলো জনজীবনে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। দ্রুত অগ্রসরমাণ বিশ্বে এখন অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে প্রযুক্তিনির্ভরতার বিকল্প নেই। কিন্তু এডিবির আওতাধীন এলাকা, যা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপমালা থেকে আফগানিস্তান পার হয়ে ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই অঞ্চলের ৮৮ শতাংশ মানুষ এখনো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের সুযোগ পাচ্ছে না। অন্যদিকে একেবারে প্রাথমিক প্রযুক্তির যেসব সুবিধা, এমনকি উন্নয়নশীল বেশ কিছু দেশের নাগরিকদের জন্যও সহজলভ্য হয়ে উঠেছে, যেমন আবাসিক বাসভবনে বিদ্যুৎ-সংযোগ এবং নিরাপদ পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, সেদিক থেকেও এ অঞ্চলের অবস্থান তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এই দুই ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে ব্রডব্যান্ড সংযোগ না পাওয়া জনগোষ্ঠীর হার ৮৮ শতাংশ। অন্যদিকে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এই সংখ্যা প্রায় ১৫০ কোটি। এশিয়ার জাদুর কথা এডিবির পাশাপাশি বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার মোড়লেরা প্রায় দুই দশক ধরে বলে যাওয়া সত্ত্বেও এই ছবি কিন্তু জাদুর সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে এশিয়ার চমকপ্রদ অগ্রগতির অনেকটাই বলা যায় আটকে থাকছে ওপরের সারির মানুষের আরাম-আয়েশের জীবনের দুষ্টচক্রে।

এডিবির মূল্যায়নে অবশ্য কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ সম্পর্কে যথেষ্ট উচ্চাশাপূর্ণ অভিমত লক্ষ করা যাচ্ছে। এর পেছনে অবশ্যই আছে দেশটির অনেকাংশে নিজস্ব উদ্যোগের উন্নয়ন প্রচেষ্টা। ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্জিত প্রবৃদ্ধির ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারকে দৃষ্টান্তমূলক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে এডিবির প্রেসিডেন্ট তাকেহিকো নাকাও যে একটিমাত্র দেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, সেটিও বাংলাদেশ। তিনি বলেছেন, এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সফরকালে এডিবির সহায়তায় পরিচালিত প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি স্কুলে আইটি শিক্ষা কর্মসূচি দেখার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। সেখানে এক বালিকা তাঁকে বলেছে, তার স্বপ্ন মহাকাশ প্রকৌশলী হয়ে নাসায় চাকরি পাওয়া। এডিবির প্রধান বলেন, এতে তিনি অবাক হলেও তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে দেশে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের একটি স্কুলের এক বালিকা পর্যন্ত এ রকম স্বপ্ন দেখতে পারে, সেই দেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পিছিয়ে থাকতে পারে না এবং বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সেই বাস্তবতারই প্রকাশ।

সম্মেলন চলাকালে এডিবির দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হুন কিম আমাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সাফল্যগাথা আমাদের উৎসাহিত করছে এবং দেশটি নিয়ে আমরা এখন আশাবাদী।’ তবে তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে আরও অনেক আশাবাদী হওয়া যেত।

এডিবির এই আমলা সজ্জন মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি তাঁর আছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। তবে তারপরও বলতে হয় আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক আর্থিক নিয়ন্ত্রকদের যে প্রবণতা, নিজেদের মূল্যায়নের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা থেকে তিনি হয়তো বেরিয়ে আসতে পারেননি, অথবা কাজের ধরনের জন্যই হয়তো তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারায় সবচেয়ে বড় দুই বাধা হচ্ছে সম্পদের অসম বণ্টন ও দুর্নীতি। সম্মেলনে সমবেত প্রতিনিধিদের নেতিবাচক সেই দুটি দিকের ওপর খুব বেশি নজর না পড়লেও আমরা জানি, আমাদের প্রবৃদ্ধি আরও অনেক বেশি অর্থবহ হয়ে উঠতে পারত, যদি সেই দুই পাগলা ঘোড়ার লাগাম আমরা টেনে ধরতে পারতাম। ফলে সাফল্য সত্ত্বেও এখানেই বোধ হয় চিহ্নিত হয়ে আছে আমাদের ব্যর্থতা।

তবে তা সত্ত্বেও দেশের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো না লাগে। আমার নিজের বুকটাও একটু ফুলে উঠেছিল যখন কিনা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক পারদর্শিতার দিক থেকে তারকা দেশকে বেছে নিতে হলে কোন দেশকে বেছে নেওয়া যায়, আমার সেই প্রশ্নের উত্তরে হুন কিম বাংলাদেশের উল্লেখ করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন যে ভারত এখন স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে সম্মুখযাত্রা আবারও শুরু করায় দেশটির বর্তমান অবস্থান বিশাল অর্থনীতির কারণেই হয়তোবা কিছুটা ভালো।

মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক