Thank you for trying Sticky AMP!!

আইনি কাঠামোয় রোহিঙ্গারা মানবিক বিবেচনা পাক

টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির

দন্ত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে এক বার্মিজ নাগরিক ভারতে গিয়েছেন। তাঁকে দেখার পর ভারতের চিকিৎসকের প্রশ্ন, ‘তোমাদের দেশে দন্তচিকিৎসক নেই?’ রোগীর উত্তর, ‘আলবৎ আছে, কিন্তু মিয়ানমারে আমাদের মুখ খোলা নিষেধ।’

মিয়ানমারের সামরিক শাসনের তাণ্ডবের ছিটেফোঁটা নমুনা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে (অক্টোবর ২৯, ২০০৭) প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা এই কৌতুক দেড় দশক পর যেন মিয়ানমারের অবস্থা তুলে ধরার ক্ষেত্রে আরও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে, ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বর্ষপূর্তিতে গত বছরের ঘটনাবলি নির্দেশ করে, সে দেশের সামরিক সরকার সেখানকার মানুষের মুখ বন্ধ রাখার সব রকম বন্দোবস্ত করে রেখেছে।

সামরিক সরকারের বর্ষপূর্তি
মিয়ানমারের সামরিক সরকার এক বছর পার করে ফেলল। পরিহাসের বিষয়, সামরিক সরকারকে আঞ্চলিক জোট ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো শুরুতে সাময়িক তিরস্কার ও ভর্ৎসনা জানালেও ক্রমশ তারাও মুখ না খোলার দলে নাম লিখিয়েছে। এক বছরে দেড় হাজার মানুষকে হত্যা ও সাড়ে ১১ হাজারের বেশি লোককে গ্রেপ্তারের করেছে সামরিক সরকার। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যেমন ২০১৬-১৭ সালে বাধ্য করা হয়েছিল নিজ দেশে ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে, তেমনি এ সরকার মিয়ানমারের থাই-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা কারেন ও কায়াহ থেকে প্রায় দুই লাখ জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক বাধ্য করেছে থাইল্যান্ড চলে যেতে। গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক অবস্থানগত গুরুত্ব এবং এর প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়াসহ অনেক দেশ ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবে।

এক বছরের জরুরি অবস্থা শেষে তারা ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সেই নির্বাচন যখনই হোক আর তার ফল যা–ই হোক, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে যে তা কোনো কাজে আসবে না, সেটি সহজাত বুদ্ধি প্রয়োগে অনায়াসে বোঝা যায়। কিন্তু তাই বলে কি রোহিঙ্গা সংকটের বয়স কেবল বাড়তেই থাকবে আর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কেবল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রহর গুনবে? এতে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর হয়তো কিছু যায় আসে না, কিন্তু বাংলাদেশের?

সামরিক সরকারের শুরুর দিকে অনেকে আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন যে এবার বুঝি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। সামরিক সরকার হয়তো বিশ্বের কাছে নিজের বৈধতা অর্জনের জন্যই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি হবে। সময় বলে দিয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ছাড়াও সামরিক সরকার নিজ বৈধতা আদায় করে নিতে পারে। তবে কি বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিকল্প ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের কথা ভাববে না?

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কি কেবল প্রত্যাবাসনে?
বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার মানদণ্ডে বিশ্বের সর্বোচ্চস্থানে আসীন হয়েছে। প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম মৌলিক অধিকার তথা—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা নিয়ে এ দেশে বসবাস করার সুযোগ দেওয়া তাই বাংলাদেশের জন্যই সবচেয়ে বেশি জুতসই কাজ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ বিতর্কে মত্ত হবেন এই যুক্তিতে যে, রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে বাস করতে দেওয়া মানে মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যাকে সমর্থন জানানো। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের বিচার আদায়ে ব্যর্থ হয়, তাহলেই সেটি হবে গণহত্যার প্রতি সমর্থন।

বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা লাভ, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, কর্মদক্ষতা সৃষ্টি, কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে পারলে তা কেবল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নয়, বাংলাদেশের মানুষকেও নিরাপদে রাখবে। আর তারা অন্ধকারে বেড়ে উঠলে মাদক, পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে সম্পৃক্ত হবে এবং তার প্রভাব অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিকদের ‍ওপর পড়বে। কারণ নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না।

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান বলতে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বুঝে থাকি নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়াকে। তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ কী করবে, সেটি কদাচিৎ আলোচনায় আসে। আমাদের নিশ্চয়ই সেই বার্মিজ নাগরিকের মতো মুখ বন্ধ রাখার অবস্থা নয়?

বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা লাভ, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, কর্মদক্ষতা সৃষ্টি, কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে পারলে তা কেবল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নয়, বাংলাদেশের মানুষকেও নিরাপদে রাখবে। আর তারা অন্ধকারে বেড়ে উঠলে মাদক, পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে সম্পৃক্ত হবে এবং তার প্রভাব অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিকদের ‍ওপর পড়বে। কারণ নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না।

তাহলে কোথায় প্রতিবন্ধকতা?
বাংলাদেশে শরণার্থীবিষয়ক আইন না থাকা এ ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। অবশ্য তার চেয়েও বড় বাধা হলো অল্প কয়েক হাজার নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গা ছাড়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে শরণার্থীই মনে না করা। স্বীকৃত-অস্বীকৃত উভয়ের জন্য বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বার রুদ্ধ। অথচ উখিয়া ও টেকনাফের নিবন্ধন করা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদের ভিত্তিতে স্থানীয়, এমনকি কক্সবাজারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে, সেটি কেবল গবেষকদের নয়, নীতিনির্ধারকদেরও জানা।

মূলত পরিচয় গোপন রেখেই তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। কক্সবাজারের বাইরের বিভিন্ন জেলাতেও অনানুষ্ঠানিক, এমনকি আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তাদের প্রবেশ আজ অবারিত। আইনের অনুপস্থিতি কিন্তু তাদের জীবনকে থামিয়ে দিতে পারেনি। বরং তাদের কেউ কেউ বিকল্প পথ বের করে নিয়েছে সন্তানের লেখাপড়া ও কাজের জন্য। আর অনিবন্ধন করা রোহিঙ্গা, যাদের এফডিএমএন বলা হয়, তাদের শিশু-কিশোর-তরুণেরা বড় হচ্ছে শিক্ষাবঞ্চিত বাস্তবতায়।

বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না নিয়েও রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিচয় নিয়েই যে তারা লেখাপড়া শিখতে ও কর্মদক্ষতা অর্জন করতে পারে, এটি এখনো আমরা ভাবতে পারি না। রোহিঙ্গাবিষয়ক দেশি আইন না থাকলেও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আইনে বাংলাদেশের স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন প্রমাণ করে যে মানবিকতার অবস্থান থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু মৌলিক অধিকার পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশের। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র, ইন্টারন্যাশনাল কাভন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস, ইন্টারন্যাশনাল কাভন্যান্ট অন ইকোনমিক, সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল রাইটস ইত্যাদির কথা বলা যায়। তা ছাড়া রিফিউজি এবং মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য (২০১৬ সালের রিট পিটিশন নম্বর ১০৫০৪) মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ পর্যবেক্ষণ দেন, রিফিউজি কনভেনশনে যদিও বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি, এটি আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনে পরিণত হয়েছে। তাই কোনো রাষ্ট্র এই কনভেনশনটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর বা অনুসমর্থন করুক বা না করুক এটি প্রতিটি রাষ্ট্রের ওপর বাধ্যতামূলক।

এই মামলার মূল বিচার্য বিষয় ছিল শুধু উদ্বাস্তু কনভেনশনের ৩৩ অনুচ্ছেদ। আর এই ৩৩ অনুচ্ছেদ শুধু কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার জন্য নির্যাতনের হুমকি রয়েছে এমন কোনো দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কথা বলে। তাই এই মামলার মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার জন্য অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কোনো আইনগত দায়িত্ব অর্পিত হয়নি।

কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো রায়ের মাধ্যমে যে আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তা আইনি মর্যাদা লাভ করে। তাই কোনো আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো, দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশন বা বিদেশি এনজিওর চাহিদা মতো নয়, শরণার্থীবিষয়ক আইন প্রণয়ন করার মাধ্যমে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে মৌলিক মানবাধিকার দেওয়া সম্ভব। তখন আর তাদের ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ জোগাড় করে নাম-পরিচয় লুকিয়ে স্কুল–কলেজে যেতে হবে না, কিংবা দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হবে না। অবশ্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কে স্কুলে যাবে বা যাবে না ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য রাষ্ট্রের চাওয়াটুকুই যথেষ্ট। যেমনটি আমরা দেখেছি ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে। যদিও এটি সংকটের সমাধান তো নয়ই, বরং শিক্ষাহীন, কর্মহীন, পরিচয়হীন এক বিশাল জনগোষ্ঠীর কতিপয় সদস্যকে বেঁচে থাকার সব শর্ত অপরিবর্তিত রেখে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া মাত্র।

কোভিড, অমিক্রন, চীন-আমেরিকা বৈরিতা, আফগানিস্তান ইত্যাদি ইস্যুতে রোহিঙ্গা ইস্যু এখন তালিকার পেছনের দিকে। মানবিকতার দৃষ্টান্তে অনন্য বাংলাদেশ গণহত্যাকারীদের বোধদয়ের আশায় না থেকে এবং আন্তর্জাতিক আদালত তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখের দিকে চেয়ে না থেকে দেশি আইনি কাঠামো প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক পদক্ষেপ নিক। রোহিঙ্গাদের জন্য তো বটেই, বাংলাদেশের জন্যও তা কল্যাণকর হবে।

  • ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

  • ড. মো. রিজওয়ানুল ইসলাম অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ। লেখকদ্বয় সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।