Thank you for trying Sticky AMP!!

আওয়ামী লীগের উদ্বেগ বাড়ছে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একেবারে দরজায় কড়া নাড়ছে। ডিসেম্বরের শেষেই নির্বাচন—এমন কথা সরকারি দলের সম্পাদক ও নির্বাচন কমিশনের সচিবের মুখ থেকে বেরিয়েছে। তা ছাড়া সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো সংশয় নেই। পাশাপাশি তাঁর ও দলের নেতা-কর্মীদের প্রাণনাশে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের সম্পৃক্ততা নিয়ে সম্প্রতি তিনি স্পষ্টভাবে অভিযোগ তুলেছেন। আর ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়ার সম্পৃক্ততার বিচার করতে না পারায় খেদ প্রকাশ করেছেন। তিনি এবং মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যও বিএনপিকে খুনিদের দল হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।

চলতি মাসেই নিম্ন আদালত থেকে ২১ আগস্টের মামলার রায় পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষ তারেক রহমানসহ অভিযুক্ত ৪২ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের মর্মান্তিক, অনভিপ্রেত এবং অবৈধ কয়েকটি ঘটনার বিচার হতে দেয়নি বিএনপি। পঁচাত্তরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে সপরিবার হত্যা, নভেম্বরে জেলহত্যা যেমন, তেমনি ২১ আগস্ট আইভি রহমানসহ ২২ জনের হত্যাকাণ্ড এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রাণনাশের লক্ষ্যে হামলার বিচার তারা ঠেকিয়ে রেখেছিল, অকারণে বিলম্বিত করেছিল ও মামলাকে ভিন্ন খাতে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল। বিএনপি বরাবর অস্বীকৃতি এবং যুক্তির গোঁজামিল দিয়ে এসব আচরণ বা ভূমিকার দায় এড়াতে চেয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবার ও দল এবং তারও চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার অংশীদার মানুষ কীভাবে এসব ঘটনার দায় থেকে বিএনপিকে মুক্তি দেবে? এর বিপরীতে সিরাজ শিকদারের হত্যাকাণ্ড, রক্ষী বাহিনীর ভূমিকাকে পাল্টা অভিযোগ হিসেবে খাড়া করলেও তা সে সময়কার সরকারের প্রশাসনিক সমালোচনা হিসেবে উঠতে পারে। তার পাল্টা অবশ্য জিয়ার আমলে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি বা ১৯টি ক্যুর বিপরীতে গোপন বিচারে বা নির্বিচারে অসংখ্য মৃত্যুদণ্ডের অভিযোগও উঠবে। এসব ঘটনারও আইনগত নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়, তবে পঁচাত্তরের আগস্ট বৈধ সরকার এবং নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ও ২১ আগস্টের হামলা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর সংঘটিত হয়েছিল। তার সঙ্গে দেশের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস ও চেতনার সম্পর্ক জড়িত। ইতিহাসের রায় একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তবে ইতিমধ্যে পঁচাত্তরের আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের আইনি বিচার হয়েছে, পলাতক কয়েকজন ছাড়া বাকিদের দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। জেলহত্যার বিচার এখনো হয়নি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের অপেক্ষায় জাতি।

বিএনপি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস ও চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু কাজ করেছে, যার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেনি। এ নিয়ে অভিযোগের অবকাশ থাকলেও বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির পক্ষে জনসমর্থন রয়েছে। এই সমর্থকদের সম্পর্কে প্রচলিত বক্তব্য হলো দেশে মুসলিম লীগের মানসিকতার যে মানুষজন আছেন, এই দল তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করে। এই মানসিকতার মধ্যে সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তার চেতনা, ভারতবিরোধিতা ও পাকিস্তান-সৌদিপ্রীতি মুখ্য বিষয়। ভাবা হয়েছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই মানসিকতাকে বাঙালি প্রত্যাখ্যান করেই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করেছে। কিন্তু প্রায় স্বাধীনতার পর থেকে এবং পঁচাত্তরের পরে ক্রমেই পরিষ্কার হয়েছে যে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যতই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হোক না কেন, কার্যত সমাজমানস পুরোনো ধ্যানধারণাই আঁকড়ে আছে।

আদতে সমাজসংস্কার ও সঠিক শিক্ষা বিস্তারের দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলন ও কাজ ব্যতীত সমাজের রূপান্তর-উত্তরণ সম্ভব নয়। এর পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো বৃহত্তর গ্রামসমাজ এখনো মাদ্রাসা-শিক্ষিত ইমাম-মাওলানার প্রভাবেই রয়েছে, যাদের সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনায় সেক্যুলার হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। এটা ঠিক যে ব্যক্তিগত জীবনে পরম ধার্মিক হয়েও সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকে নিতান্ত ইহজাগতিক বিষয় হিসেবে দেখা সম্ভব, তাতে ধর্ম পালনে কোনো বাধা হয় না। কিন্তু আগের কারণগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী হিন্দুপ্রধান ভারতের অবস্থান, তদুপরি সাম্প্রতিক কালে সেখানে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থানে ক্রমেই দেশটিতে হিন্দু ও হিন্দুত্বের প্রাধান্য এবং মুসলিমবিদ্বেষ ও তার প্রান্তিকতা প্রকট হতে থাকায় এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম লীগের রাজনীতি একাত্তর-উত্তর বাংলাদেশে আর তামাদি হতে পারেনি। তার ওপর এখন পশ্চিমের ভূমিকার ফলে বিশ্বব্যাপী মুসলিমসমাজে প্রতিক্রিয়ার ক্ষোভ জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে।

একাত্তরের বিজয়, পঁচাত্তর ও ২০০৪-এর হত্যা-হামলার ঘটনার ঝড়ঝাপ্টা উজিয়েও পুরোনো পাকিস্তানি চেতনার রাজনীতি বাংলাদেশে কিছুতেই আর তামাদি হচ্ছে না। তার ওপর ভর করে বিএনপি দেশের অপর বৃহৎ দলের ভূমিকা পালন করছে, মর্যাদা পাচ্ছে। এর বাইরেও কথা থাকছে। প্রায় ১০ বছর ধরে শেখ হাসিনা দক্ষতার সঙ্গেই সরকার চালিয়েছেন। বিডিআর বিদ্রোহসহ বড় বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তিনি উতরে গেছেন ভালোভাবে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর নির্বাচনী ঘোষণা রূপায়ণের মাধ্যমে দেশ উন্নয়নের পথেই এগোচ্ছে। মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন, সামাজিক সূচক, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ অবকাঠামো—প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নয়ন হয়েছে। বিপরীতে অবশ্যই বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মাদকের প্রসার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, নির্বাচন-প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, আর্থিক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির অভিযোগ তোলা যাবে। নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগ উন্নয়নের ফিরিস্তি নিয়ে গর্ব করতে পারবে। সেই সঙ্গে বিএনপি এবং এর মূল নেতাদের ঐতিহাসিক ভুল নিয়ে অভিযোগগুলো উত্থাপন করবে। বিএনপি নিশ্চয় এর জবাব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক শাসন নিয়ে কিছু নেতিবাচক ফিরিস্তি তুলে ধরতে পারবে। সেই সঙ্গে পুরোনো ভান্ডার থেকে রক্ষী বাহিনী, বিশেষ ক্ষমতা আইন, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথা টেনে আনবে।

তবে আমার ধারণা, এই প্রচারণার চেয়েও আওয়ামী লীগ নিজ দলের অনেক নেতা-কর্মীর বিতর্কিত ভূমিকাতেই পিছিয়ে যেতে পারে ভোটের রাজনীতিতে। দেখা যাচ্ছে গত পাঁচ-ছয় বছরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এলাকা দখল, প্রতিপত্তি অর্জন, স্থানীয় প্রশাসনকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে এলাকাভিত্তিক নানা দল-উপদলে সরবে-নীরবে লুটপাটসহ বেপরোয়া ভূমিকায় রয়েছেন। দলীয় নেতৃত্ব তাঁদের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যবহার করতে পারছেন না, আবার তাঁদের কারণেই সৃষ্ট সমালোচনা ও জনরোষের দায়ও এড়াতে পারবেন না।

আর যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে প্রচারণায় ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে সহজেই নির্বাচনী মাঠে এগিয়ে থাকার ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত ছিল সরকার, তাকে জনগণ শেখ হাসিনা ও সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে দেখলেও আওয়ামী লীগকে সে কৃতিত্বের ভাগ দেবে না। বাস্তবে মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে মন্ত্রী-সাংসদ ও নেতাদের মদদে নিজ নিজ এলাকায় তাঁদের পোষ্যদের মধ্যে ক্ষমতা, বিত্ত, এলাকা দখল ও দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিরন্তর ঝগড়া-সংঘর্ষ ও খুনোখুনি প্রত্যক্ষ করছেন এবং তাতে ক্ষমতামত্ত আওয়ামী লীগের রাজত্বে নিজেদের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এটাই হবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়। এ অবস্থায় উন্নয়নের কাজগুলো বহুলাংশে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমেই জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে। বলা যায় এর প্রত্যক্ষ জোগানদার রাষ্ট্রের ছোট-বড় কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদ সেসব অনুষ্ঠানে কেবল শোভাবর্ধন কিংবা কখনো শোভার বিঘ্ন ঘটান। কিন্তু দেশে সামাজিক অস্থিরতা, অবিচার ও জবরদস্তির যে উৎপাত চলছে, তার অভিযোগের তির আওয়ামী লীগ দলের দিকেই যাচ্ছে। ফলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের কৃতজ্ঞতা কাকে জানাবে, সে বিষয়ে জনগণ সন্দিহান। মোট কথা উন্নয়নের ফল জনগণ ভোটের বাক্সে আওয়ামী লীগের অনুকূলে দেবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

আর তাই আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারে থেকেও আওয়ামী লীগের পক্ষে নিশ্চিন্ত থাকা সম্ভব নয়।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক