Thank you for trying Sticky AMP!!

আত্মস্বীকৃত তিন খুনির সঙ্গে আর কারা ছিল

হত্যা

রোববার সকাল ও সন্ধ্যায় দুই দফা কথা হয় নিহত প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী ও ছোট ছেলের সঙ্গে। তাঁরা মামলার তদন্তকাজের ধীরগতিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন। দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী খোদেজা আক্তার বললেন, ‘কেন আমি স্বামীকে হারালাম, আমার সন্তানেরা বাবাকে হারাল?’ তিনি তো কোনো অপরাধ করেননি। সততার কারণেই তাঁকে জীবন দিতে হলো।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন খুন হন ১১ মে। মিরপুর ২ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে সকালে অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। দেলোয়ারকে নিতে এসেছিলেন তাঁরই সহকারী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান ওরফে সেলিম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভাড়াটে খুনি শাহিন ও গাড়িচালক হাবিব। দেলোয়ার হোসেন সাধারণত সিটি করপোরেশনের গাড়িতে যাতায়াত করতেন। কিন্তু ওই দিন তাঁর অধস্তন সেলিম অফিসের গাড়ি না এনে কালো গ্লাসের একটি ভাড়া করা মাইক্রোবাস নিয়ে আসেন।

এক প্রশ্নের জবাবে ছোট ছেলে রোমেল হোসেন জানান, আদালতে প্রকৌশলী সেলিম যে জবানবন্দি দিয়েছেন, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি (সেলিম) বলেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে দেলোয়ার হোসেন তাঁকে বকাঝকা করতেন, এ জন্য তাঁকে খুন করেছেন। শুধু সামান্য বকাঝকার কারণেই কেউ তার ঊধ্বতনকে এভাবে পরিকল্পনা করে খুন করেছে, এটা আসলে কতটা বিশ্বাসযোগ্য? এর পেছনে অন্য কারণ রয়েছে।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রোমেল হোসেন বলেন, বাবা খুন হয়েছেন প্রায় দুই মাস হলো। এর মধ্যে পুলিশ তদন্তকাজ শেষ করেনি। আগে তদন্তকারী কর্মকর্তারা যোগাযোগ করতেন, এখন তা–ও করেন না। স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাবে তদন্তকাজে বাধা দিচ্ছে বলে মনে করেন রোমেল। কয়েক দিন আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া নিহত প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী খোদেজা আক্তারকে টেলিফোনে বলেছেন, আদালতে যঁারা হত্যার কথা স্বীকার করেছেন, তিনি যেন তাঁদের বাইরে কারও নাম না বলেন।

এ বিষয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ওই কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটি আপনাকে বলতে যাব কেন?’ এ ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস তিনি কোথায় পেলেন সেটা এক বড় প্রশ্ন? সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এ জন্য হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সাফাই গেয়েছেন। এতে এ ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে সিটি করপোরেশনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিহত প্রকৌশলীর স্ত্রীকে টেলিফোন করে আর কারও নাম না বলার ব্যাপারে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে মেয়রের সমর্থন রয়েছে।

আমরা এমন এক দেশে বাস করছি, যেখানে নিহত ব্যক্তির পরিবারের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, সেখানে উল্টো তাঁর স্বজনকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। খোদেজা আক্তার বললেন, তাঁর স্বামীর হত্যা মামলার তদন্ত যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে তাঁরা ভরসা রাখতে পারছেন না। ছেলে রোমেলের দাবি, তাঁর বাবার মামলাটির তদন্তভার পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) দেওয়া হোক। ফেনীর নুসরাতসহ সাম্প্রতিক আলোচিত অধিকাংশ হত্যা মামলা পিবিআই তদন্ত করে আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।

রোমেল আরও বললেন, তাঁরা ভয়ভীতিতে আছেন। করোনার কারণে তাঁর কলেজ বন্ধ। তারপরও জরুরি প্রয়োজনে বাইরে গেলে মনে হয়, তাঁকে কেউ অনুসরণ করছে। তাঁর সামনে দিয়ে একই গাড়ি বারবার চলে যেতে দেখেছেন। টেলিফোনে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তার হুমকির বিষয়ে থানায় জিডি করার পরও পুলিশ আসেনি।

খোদেজা বেগম ও তাঁর সন্তানদের একটাই দাবি, হত্যার বিচার হোক। এর সঙ্গে যাঁরা জড়িত, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের বাইরে কাউকে তাঁরা সন্দেহ করেন কি না, জানতে চাইলে রোমেল বলেন, ‘এটি খুঁজে বের করা পুলিশের দায়িত্ব। আমরা শুধু বলছি, একজন মানুষ বকাঝকা করেছেন, এ কারণে খুন হতে পারেন না।’

খোদেজা আক্তার জানান, সিটি করপোরেশনে তাঁর বড় ছেলেকে চাকরি দেওয়ার কথাও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু যেখানে চাকরি করতে গিয়ে বাবা জীবন দিয়েছেন, সেখানে সন্তানকে পাঠাবেন কোন ভরসায়?

ভাড়াটে খুনি শাহিনের জবানবন্দি অনুযায়ী, প্রকৌশলী সেলিম তাঁদের ভাড়া করে আনেন। গাড়িটি রূপনগর বেড়িবাঁধে উঠতেই সেলিম তাঁকে ইশারা দেন এবং তিনি (শাহিন) পেছন থেকে প্রকৌশলী দেলোয়ারের গলায় রশি পেঁচিয়ে টান দেন। এ সময় সেলিমও তাঁকে হত্যার কাজে সহায়তা করেন। পরে উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের একটি খালি প্লটে তাঁর মরদেহ ফেলে চলে যান।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলছেন, দেলোয়ার হোসেন সৎ কর্মকর্তা ছিলেন। সিটি করপোরেশনে নিম্নমানের উন্নয়নকাজ করায় তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারের অন্তত শতকোটি টাকার বিল আটকে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কোনাবাড়ী এলাকায় এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ৩৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। জাইকা, এডিবি ও আরও একটি দাতা সংস্থার নামে পৃথক বিল তৈরি করা হয়। অর্থাৎ মোট ৯৯ কোটি টাকার বিল করা হয়। একই কাজে পৃথক তিনটি সংস্থার নামে জমা দেওয়া বিল দেলোয়ার আটকে দেন। এ ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় সুপেয় পানির লাইন স্থাপনে শতকোটি টাকার একটি বিল তিনি অনিয়মের অভিযোগে আটকে দেন। এসব নিয়ে তাঁর সঙ্গে সহকারী প্রকৌশলীদের দ্বন্দ্ব ছিল।

দেলোয়ার হোসেন ছিলেন বুয়েট ’৮৬ ব্যাচের প্রকৌশলী। তাঁর হত্যার বিচার ও খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছিল বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থী ফোরাম, বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও প্রকৌশলী ইনস্টিটিউশন। কিন্তু তদন্তে অগ্রগতি নেই।

আলাপ প্রসঙ্গে দেলোয়ারের এক সতীর্থ প্রকৌশলী জানান, খুলনায় একজন চিকিৎসক নিহত হওয়ার পর চিকিৎসকেরা ধর্মঘটের হুমকি দেওয়ার পর সরকার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। দেলোয়ারের ব্যাপারেও প্রকৌশলীরা মাঠে নামলে এত দিনে মামলার তদন্ত শেষ হয়ে যেত। তুরাগ থানার পুলিশের ভাষ্য, গ্রেপ্তার হওয়া তিন আসামিই হত্যার কথা স্বীকার করেছেন এবং তাঁরা কারাগারে আছেন। কিন্তু তাঁদের বাইরে আরও কেউ দেলোয়ারের হত্যার সঙ্গে জড়িত কি না, তদন্তের মাধ্যমে তা জানা যাবে।

নিহত ব্যক্তির পরিবার তদন্তের ভার পিবিআইকে দিতে বলেছে। এ ক্ষেত্রে আইজিপির অনুমোদন প্রয়োজন। আইজিপি সম্প্রতি পুলিশকে বদলে যেতে বলেছেন, ঘুষ-দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। নিহত ব্যক্তির পরিবার যে তদন্তে আস্থা পাবে, সেটা নিশ্চিত করা তাঁর দায়িত্ব।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com