Thank you for trying Sticky AMP!!

আনিস-সৌরভে...

আনিসুল হক

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাদাকালোর যুগ, রঙিনের আভা তখনো প্রস্ফুটিত হয়নি। এক তরুণ তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত শাণিত মেধা এবং সাবলীল বাচনভঙ্গিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে দর্শকের মনে রং ধরিয়ে দিলেন। পরবর্তী অনুষ্ঠান দেখার আকুল আগ্রহ নিয়ে দর্শকের অপেক্ষা।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান এখনই উপস্থাপনায় আনিসুল হক। আজকাল রঙিন আলোর ঝলসানিতে অনুষ্ঠানগুলো গভীরতা হারিয়ে ফেলেছে। আজ যদি আনিসুল হকের সেই সব অনুষ্ঠান পুনঃপ্রচার করা যেত, তা দেখে অন্যরা লজ্জায় মাথা নত করবেন, আমার দৃঢ়বিশ্বাস। কেননা তাঁদের মতো আলোর ঝলসানি ছিল না কিন্তু ছিল নির্মল বিনোদন—দর্শকের মন জয় করার মতো নানা বিষয়। মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান তৈরিতে প্রবল আগ্রহ, মেধা এবং বেশ কজন গুণী ব্যক্তিত্বের সহায়তায় তিনি তৈরি করতেন প্রতিটি অনুষ্ঠান। অতিরঞ্জন ছিল না, কাউকে তির্যক ভাষায় আক্রমণাত্মক কোনো সংলাপ কখনো বলেননি। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা কোনো কিছু সংরক্ষণ করতে পারি না।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আনিসুল হক হঠাৎ থেমে গেলেন (আমরা থামতে জানি না, বছরের পর বছর একই অনুষ্ঠান করে যাচ্ছি)। দৃশ্যপট পরিবর্তন করলেন। রুটি-রোজগারের ভিন্ন পথের নিশানা। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, নতুনভাবে যাত্রা, বাণিজ্যে বসতি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে গড়ে তুললেন বিশালাকার মোহাম্মদী গ্রুপ, চলে এলেন বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। পরের উত্থান সবার জানা।

জনদরদি বন্ধুবৎসল আত্মবিশ্বাস—সব মিলিয়ে আনিসুল হক হয়ে উঠলেন একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব—রোলমডেল। কখনো পেছনে তাকাননি, দৃঢ়প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন। নতুন ধারার দিকনির্দেশনা দিতে তাঁর মুনশিয়ানার তুলনা ছিল না।

আজ বাংলাদেশের যুবসমাজের বিরাট একটি অংশ দিগ্‌বিদিকশূন্য, ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাসের মহাজালে জড়িয়ে সুস্থ জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অন্যরাও ধ্বংসের খেলায় মত্ত। প্রতিদিন পত্রিকায় নিষ্ঠুরতার খবরে আঁতকে উঠি। ধর্ষণ-খুন-ডাকাতি-রাহাজানি নিত্যদিনের ঘটনা; মাদকের মরণ নেশায় বুঁদ হয়ে আছে কিশোর-কিশোরী আর যুবসমাজের বিরাট এক অংশ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতিতে তলিয়ে যাচ্ছে। আনিসুল হক আলোকবর্তিকা হয়ে ক্ষয়ে যাওয়া ঘুণে ধরা সিটি করপোরেশনের হাল ধরলেন।

কিন্তু বিধি বাম! সইল না। আনিসুল হক মেয়র হিসেবে কাজ করার সময় পেয়েছেন মাত্র আড়াই বছর। তাঁর আগেরজন ছিলেন ১০-১২ বছর। কী অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা ছিল নগর ভবনে! আনিসুল হক দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করলেন; ঢাকাবাসীর প্রিয় শহরকে সত্যিকার অর্থে তিলোত্তমা নগরী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখলেন এবং সেই স্বপ্নে আমাদেরও শরিক করলেন। বদলে যেতে লাগল অনেক কিছু। জরাজীর্ণ এই নগরকে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন আনিসুল হক। কোনো মাস্তান, সন্ত্রাসী তাঁকে দমাতে পারছিল না। হঠাৎ লক্ষ করলাম, এই দুই বছরে তাঁর তারুণ্যদীপ্ত মুখাবয়বে বয়সের ছাপ পড়ে গেল। তবু সবার কাছে তাঁর আকুল আবেদন—আসুন, আমরা আমাদের প্রিয় শহরকে রক্ষা করি সব রকমের অশুভ আগ্রাসন থেকে।

শুধু যে নিজে স্বপ্ন দেখতেন তা-ই নয়, অন্যদেরও স্বপ্ন দেখাতেন। আর সেই স্বপ্ন সফল করার সংগ্রামে নেমেছিলেন তিনি। এই প্রতিভার আকালের দেশে অল্প কজন প্রতিভাবান ও পরিশ্রমী মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কিন্তু হায়! অকালেই ঝরে গেলেন।

আনিসুল হক এখন ঊর্ধ্বলোকে, না-ফেরার দেশে। তাঁর কর্মজীবনের ওপর গবেষণা করে তরুণসমাজকে জানাতে হবে একজন মানুষের নিজ প্রচেষ্টায় একেবারে শূন্য থেকে শিখরে উঠে আসার গল্প। আমি বিশ্বাস করি তারা তা পারবে, আনিসুল হক তাদের রোলমডেল। তাঁর সততা-দেশপ্রেম-মানবপ্রেম তরুণসমাজের মাঝে সঞ্চারিত হোক। ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদকের মরণ ছোবল থেকে সোনার বাংলাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে আগামী প্রজন্মকে। অমিত সম্ভাবনার তরুণ প্রজন্মই পারবে ঘুণে ধরা এই সমাজ, এই নগর, সর্বোপরি এই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

আনিস-সৌরভে শত ফুল ফুটুক।

কামরুননেসা হাসান: কনসালট্যান্ট, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি।