Thank you for trying Sticky AMP!!

আপনার ঘরে অরিত্রী নেই তো?

অরিত্রী অধিকারী। ছবি: সংগৃহীত

কয়েক দিন ধরে একটা কষ্ট মনের মধ্যে চেপে বসে আসে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত লাগছে। অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যা ঠিক না বেঠিক ছিল, তা নিয়ে নানা যুক্তি–আলোচনা মনটাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে। মনের পটে কিছুক্ষণ পরপর একটা কিশোরী মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি। কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকেছে সে। দরজা লাগিয়েছে। এই ঘর থেকে বের হলে কিসের মুখোমুখি হবে—এই ভয়ে হাত–পা ঠান্ডা তার। প্রাণপণে উপায় খুঁজছে। একসময় মরে যাওয়াটাকে উপায় মনে করে গলায় ফাঁস দিল সে।

এ এক নিদারুণ পরিণতি! আত্মহত্যাকে কখনোই সমর্থন করা যায় না। এটা কোনো দিনও সমস্যা থেকে বাঁচার পথ হতে পারে না। তবে অরিত্রী যে ছিল কিশোরী। ১৫ বছরের একটি মেয়ের মনে স্বভাবসুলভ যে চপলতা থাকে, আবেগের আতিশয্য থাকে, এর তীব্রতায় মৃত্যু নিয়ে গভীর কিছু ভাবার উপলব্ধি হয়তো চাপা পড়েছিল। যুক্তির চেয়ে হয়তো আবেগ-অভিমানই বড় হয়ে উঠেছে। এর পরিণতিতে যা ঘটেছে, সে তো সবারই জানা।

কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ঘটনা হলো, অরিত্রী পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিয়ে গিয়েছিল। ধরা পড়ার পর সে নকল করেছে, এমন অভিযোগ তুলে তাকে স্কুল থেকে টিসি দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। স্কুলে ডেকে পাঠানো হয়েছিল তার মা-বাবাকে। সবাই মিলে ক্ষমা চেয়েও ফল মেলেনি। অরিত্রী বাসায় ফিরে নিজের ঘরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। অথচ অরিত্রী যে নকল করেনি, তার প্রমাণ মিলেছে। তার মোবাইল ফোনে সিলেবাসের কপি ছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অরিত্রী ও ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষকদের পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি উঠে আসছে। কেউ কেউ ছোটবেলায় কে কত শিক্ষকের কাছে মার খেয়েছেন, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। মার খেয়ে কে কত বড় হয়েছেন, কত সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তার বিশদ বর্ণনা পাচ্ছি। কেউবা নকলবাজিকে সমর্থন করা হচ্ছে বলে মুখর হয়েছেন। আমার চোখে কেবল ভাসছে কিশোরী মেয়েটির মুখ। আহারে, কী মায়া! কান্নায় ভেজা মুখটায় কী অসহায়ত্ব! আমি যেন ওর জায়গায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। ছোটবেলায় কোনো একটা ভুল করে ফেললে মনটা সব সময় কিছুটা অতীতে চলে যেত। যেখানে গিয়ে আমি ভুল বা অন্যায়টা শুধরে নিতাম। অরিত্রীও কি ভেবেছিল, আহারে, অতীতে গিয়ে মোবাইলটা যদি ঘরে রেখে আসতে পারতাম!

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে অরিত্রী বিখ্যাত হওয়ার জন্য আত্মহননকে বেছে নিয়েছে। মনে হচ্ছে অরিত্রী যেন জানত আত্মহত্যা করলে তাকে নিয়ে আন্দোলন হবে, সে রাতারাতি খ্যাতি পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, কিশোরী মেয়েটির চঞ্চল হৃদয়টাকে তখন কুরে কুরে খাচ্ছিল মা-বাবার অপমান। তার অপমান।

আসলে কারও বিরুদ্ধে বা পক্ষে গিয়ে কিছু লিখতে চাই না। কেবল বলতে চাই আমাদের সন্তানদের কথা। অরিত্রীর ঘটনা কিন্তু সামনের এক অশনিসংকেত। সন্তানদের বাঁচাতে সবাইকে সামাজিক পরিস্থিতি বুঝতে হবে। কোনো শিশুই বোধবুদ্ধির পুরো বিকাশ নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। তাদের নরম মনটাকে মা-বাবার লালন করতে হয়। একসময় বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করলে এই মনটাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হয় শিক্ষকদের। এই জন্যই শিক্ষকতা পেশা মহান। শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর।

অরিত্রীর মতো কিশোর-কিশোরীদের আমরা কী দিচ্ছি, আমাদের ভাবার সময় এসেছে। কেবল নিজেদের সময়ের সঙ্গে তুলনা করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ নয়। আর যদি তুলনাই করতে হয়, তাহলে সবার উচিত পুরোপুরিভাবে ওই সময়টাকেই ফেরত দেওয়ার। ইন্টারনেট, টিভি নেটওয়ার্ক, ট্যাব, মোবাইলবিহীন একটা জগৎ। যেখানে আছে খেলার মাঠ, ভাইবোন, আত্মীয় পরিজনে মিলে গল্পের সেই চমৎকার সময়টা। সে সবকিছু না দিয়ে শুধু ক্রমাগত পড়ার চাপ, মারধর আর অপমান করে মানুষ গড়ার তরিকা নিলে বিপদ আসন্ন।

মনে হয় নিজের ছোটবেলার কথা। আমাদের সময়ে একটা চমৎকার পারিবারিক বন্ধন ছিল। বাবা-মা-ভাই-বোন ছাড়াও একটি শিশু পাশে পেত দাদা-দাদি, নানা-নানি, খালা, মামা, চাচা, ফুপুসহ অনেক আত্মীয়কে। এমনকি পাশের বাড়ির বড় আপু বা ভাইয়া, ভাইবোনের বন্ধুরাও হয়ে উঠতেন আত্মীয়ের মতো। এক অদ্ভুত জালে বাঁধা থাকত সম্পর্কগুলো। আমার ছোটবেলায় আমার সব সুকর্ম-কুকর্মের সাক্ষী আমার বড় বোন। মনে পড়ে প্রতিবেশী তামান্না আন্টিকে। প্রায় সমবয়সী এই আন্টির সঙ্গে স্কুলের সব কথা ভাগ করে নিতাম। কিশোরী মনের সব কৌতূহল যেন পারিবারিক বন্ধনেই মিটে যেত।

মজার একটা অভিজ্ঞতা বলি। কলেজে থাকতে মানবিক বিভাগ থেকে আমি উচ্চতর গণিত নিয়েছিলাম। বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল বিষয়টা আমার বুঝতে। প্রথম দুই সাময়িকীতে ফেল করলাম। বাড়িতে বলতে ভয় পাই। ফাইনালে পাস না করলে কী করব? দিশেহারা অবস্থা আমার। কলেজের গণিত শিক্ষক তাঁর এই দুর্বল শিক্ষার্থীকে আলাদা করে অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বছর শেষে আমি স্বস্তির শ্বাস নিয়েছিলাম। আগের সময়ের শিশুরা মা-বাবা ছাড়াও অনেক ভাইবোন (চাচাতো-মামাতো), খালা-ফুপু, দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ অনেক মানুষ পেত, যাঁরা তাদের কোনো না কোনোভাবে পাশে থাকত। সমস্যার মুখে তাই তারা ভেঙে পড়ত কম। কিন্তু এখনকার শিশুরা শহরের ফ্ল্যাটে কী বা কাকে পাচ্ছে? ছোটদের দোষ দেওয়ার আগে এই নতুন অমানবিক বাস্তবতাটা ভাবতে হবে।

হায়, এখনকার সময়ে আমার ছোট্ট ছেলেটি সারা দিন ১০ ফুট লম্বা একটা ঘরে ক্রিকেট খেলার বৃথা চেষ্টা করে। সারা ঘরভর্তি খেলনা, খেলার সঙ্গী না পেয়ে কান্না করে। এ এক অন্য রকম সময়। এই সময়ে নরম কাদামাটিকে শক্ত করে গড়তে হলে বুঝিয়ে, মায়া দিয়ে, ভালোবেসে বড় করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের জন্য সতর্ক হতে হবে। একা একা বেড়ে ওঠা এই প্রজন্ম কার কাছে যাবে। কিশোর হৃদয়ে অদ্ভুত কষ্ট-আনন্দগুলো ভাগ করে নেওয়ার কোনো সাথি যে তার পাশে নেই।

অরিত্রীর ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে লিখছেন, ‘মারের মধ্যে ভিটামিন আছে’, ‘অরিত্রী ঠিক করেনি’, ‘কেন বকাঝকা সামলাতে পারেনি সে, আমরা কত মার খেয়েছি’, ‘অঙ্ক স্যার পিঠের ওপর বেত ভেঙেছেন’, ‘বাবা মা অঙ্কে এক শ পাওয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন, কই আমরা তো এমন কিছু করিনি’—এমন নানা ধরনের মন্তব্য। যাঁরা লিখছেন তাঁদেরও সন্তান আছে। তাঁদের বলছি, এত সব সয়ে আপনি বড় হয়েছেন, কিন্তু এখন বলা হচ্ছে সন্তানদের কথা। তাঁরা কিন্তু আপনার যুগের নয়। এসব মন্তব্য যাঁরা করছেন, তাঁরা নিশ্চিত তো আপনাদের সন্তান কোনো দিনও এমন সিদ্ধান্ত নেবে না। মানসিকভাবে দৃঢ় হয়ে বেড়ে উঠছে তো সে।

জীবন মানে শুধু পরীক্ষায় প্রথম হওয়া নয়, জীবনে খারাপ ফলাফল আসে, খারাপ সময় আসে—এটা মোকাবিলা করার শক্তি সে পাচ্ছে তো? ভুল করে শোধরানোর সেই মনোবল আছে তো তার? তাকে মারধর করে, পড়াশোনার ভয়াবহ চাপ দিয়ে যেভাবে মানুষ করছেন, তাতে তার মনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে না তো? যে স্কুলে সন্তানকে পড়াচ্ছেন, ওই স্কুলে তার মানসিক পরিপক্বতা সঠিকভাবে হচ্ছে তো? পড়াশোনার পাশাপাশি আপনার সন্তানকে মানবিক গুণের শিক্ষা দিচ্ছেন তো শিক্ষকেরা? পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে তো সে?

আসলে একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হলো, যখন আমরা নিজেদের দোষ ঢাকতে চাই, তখন আমরা অন্যের ওপর দোষ চাপাই। অরিত্রীর আত্মহত্যায় এই সমাজের প্ররোচনা আছে, এ দায় যে একজন অভিভাবক, একজন শিক্ষক হয়ে আমরা এড়াতে পারি না। সেটা ঢাকতেই অরিত্রীর মৃত্যুতে তার ওপরই দোষ চাপিয়ে দিই। মৃত মানুষ তো নিজেকে রক্ষা করে কিছু বলতে পারবে না।

শাকিলা হক, সাংবাদিক