Thank you for trying Sticky AMP!!

আপনি এসে দেখে যান, বিচারপতি

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

অনেকভাবেই তাঁকে পেয়েছি। কিন্তু যথার্থ চিনতে পেরেছি মনে হয় এক ঘটনায়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে, মৃত্যুর কিছু আগের কথা। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তখন কলাম, সাক্ষাৎকার এসব দিতে চাইতেন না। খুব কবিতায় পেয়ে বসেছিল। বিভিন্ন ভাষার কবিতা অনুবাদ করতেন, এমনকি চীনা ভাষাও শিখতে গিয়েছিলেন। শেষের দিকে খুব মন দিয়েছিলেন এস্কিমো ভাষার কবিতার দিকে। এস্কিমো জাতির প্রাচীন কিছু কবিতা আমি খুঁজে দিয়েছিলাম তাঁকে। অবশ্য সেগুলো ছিল ইংরেজিতে। সেসব নিয়ে কথা বলতে ডাকলেন একদিন।

বিকেলের দিকে গেছি তাঁর গুলশানের বাড়িতে। অন্যদিন বসার ঘরে বা তাঁর পড়ার ঘরেই কথা হতো। সেদিন শুনলাম তিনি ছাদে। আমার আসার খবর দেওয়া হলে তিনি ডাক পাঠালেন, ‘ওপরে এসো।’ শরীর খারাপ যাচ্ছিল তাঁর। ছাদে গিয়ে দেখি, একটু উঁচু করে লুঙ্গি পরা মানুষটি ছাদের পিঠের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘ওয়াসিফ, বলো তো, এখানে কতজন মানুষ আঁটবে?’

আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় কু গেয়ে উঠল, মনে ছ্যাঁৎ করে উঠল। আমি হেঁয়ালির লাইনে গেলাম। বললাম, ‘স্যার কি আবার বিয়ে করবেন? বউভাতটা কি এখানেই হবে?’

হেসে উঠে কী বললেন তা মনে নেই। কিন্তু ছাড়লেন না, ‘বলো, কত লোক হবে?’

মৃত্যুর কথা এড়াতে চাইছিলাম। কিন্তু তাঁর কঠোরতায় আমারও মন কঠিনই হলো। বললাম, ‘স্যার, আপনার জানাজায় জাতীয় ঈদগাহ মাঠও কুলাবে না। কিন্তু এসব চিন্তায় মন দিচ্ছেন কেন? আপনি এখনো ইয়াং, কত কাজ করছেন।’

উনি হাসলেন। নিজেকেই যেন শ্লেষ করলেন। ‘আমি ও রকম জমায়েত চাই, তা তোমাকে কে বলল?’

সে সময়ে সমাজ-রাষ্ট্রের অনেক কিছুর প্রতি শুধু বিরক্তই না, প্রচণ্ড বিরাগ বোধ করছিলেন। হয়তো, তার দরকারেই লোক দেখানো শেষকৃত্য এড়িয়ে নিজ বাড়ির ছাদের ছোট জমায়েতের কাছ থেকেই শেষ বিদায় নিতে চেয়েছিলেন। এই জেদ, এই আত্মপরিহাস, এই দায়বদ্ধতা আর এই কাব্যিক প্রতিশোধ তাঁর ব্যক্তিচরিত্র বুঝতে সাহায্য করে। তাই হয়তো নিজের বাড়ির ছাদে নিজেরই জানাজা পড়াতে চেয়েছিলেন। মাহমুদ দারবিশের কবিতা: ‘নিজেরই শোকসভায় ফুল হাতে সে হাজির, কে চলে গেল তবে, কে?’

এ–ও এক কঠিন অভিমান, কায়েমি ব্যক্তিবর্গকে বলা এক ‘না’। তাঁর জীবনের সব কাজে এই আত্মাভিমান ছিল, ছিল প্রতিবাদের সাহস। তাঁর এ রকম দৃঢ়তার জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা; তখন রাষ্ট্র এক বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে যায়। সোজা কথায় দৃঢ়তা দিয়ে তিনি ক্যু ঠেকিয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। আবার তাঁর ছাত্রাবস্থার এক অভিনব প্রতিবাদের কথা পুরোনো দিনের লোকেরা করে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস শাস্ত্রে থেকে প্রথম শ্রেণিতে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেন ১৯৫১ সালে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা জারির পর ছাত্রদের যে খণ্ড খণ্ড মিছিল বেরোয়, তার একটিতে নেতৃত্বও দেন। এসব জ্বলন্ত কারণে তাঁকে শিক্ষকতায় নেওয়া হচ্ছিল না। আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন এক ‘ভুট্টো সাহেব’ থাকেন, যেমন এক ভুট্টো সাহেবের কথা শুনি সাতই মার্চের ভাষণে; যেমন ক্ষমতার মালিকেরা আমাদের কথা না শুনে সব সময় ‘ওঁদের’ কথা শোনেন; তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরির মালিকেরা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কথা না শুনে শুনল তেমন এক ‘ভুট্টো সাহেবের’ কথা। প্রতিবাদে কী করতে পারেন একজন ছাত্র? অনশন করবেন? রাগ দেখানো কিছু করে ফেলবেন? তিনি যা করলেন তা আরও অভিনব।

বিড়ি-সিগারেট বিক্রির একটা বাক্স গলায় ঝুলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরতে শুরু করলেন। বাক্সের গায়ে লেখা: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, এমএ (প্রথম শ্রেণি)। যাঁদের লজ্জা পাওয়ার তাঁরা লজ্জা পেয়েছিলেন। তখনো এই দেশে লজ্জার মৃত্যু হয়নি। এহেন সাহসী লোক আমাকে একদিন সতর্ক করলেন। তখন দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আঘাতে জান ও জবানের স্বাধীনতা কমে আসছে। এ রকম একদিনে তাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘স্যার, কী করব?’

গম্ভীর মুখ নিয়ে তিনি বললেন, ‘আগে বেঁচে থাকো’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার নিখিলেশের বন্ধুর মতো করে আজ বলতে ইচ্ছা করে, ‘আমরা কেমন করে বেঁচে আছি, আপনি এসে দেখে যান বিচারপতি।’ বলতে চাইলেও তাঁকে পাব না। ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারিতে তিনি চলে যান। শতাব্দীর প্রজ্ঞা আর আগামীর জন্য সঞ্চয় রেখে যাওয়া মানুষেরা খুব ছায়া দেন নতুনকে। তাঁরা একে একে চলে যাচ্ছেন আর আমাদের বলে যাচ্ছেন, ‘তৈরি হও, তীব্র তাপের লম্বা দিন আসছে; তখন কোনো ছায়া পাবে না। তৈরি হও বাছা।’

খুব অভিমান, অপমান আর হতাশা নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। এক সাহসী লেখার জন্য অনেক তুচ্ছ করা কথা তাঁকে শুনতে হয়। তিনিও সততায় খাটো হয়ে যাওয়া সভা-সমিতির লোকদের এড়াতে শুরু করেন। যতই হতাশা ঘনিয়ে আসছিল, যতই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ছিল, ততই আরও বেশি লেখার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ পেরি অ্যান্ডারসন অক্সফোর্ডে তাঁর বন্ধু ছিলেন। পেরির দ্য ইন্ডিয়ান আইডিওলজি বইটার কথা খুব কইতেন।

অনেকেই মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে শুধুই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি অথবা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সফল এক প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে জানেন। অনেকে তাঁকে খুব মান্য করেন কোরানসূত্র কিংবা কোরআন শরিফ সরল অনুবাদ বা যথাশব্দ নামের অভিধানের জন্য। অথচ আইনের বই লিখেছেন। তিনি আমাদের অন্যতম রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ। সংবিধানের ওপর তাঁর কাজ সাধারণ পাঠক মায় গবেষকদের কৌতূহল মেটায়। ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর লেখা বইগুলো বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি তাঁর গভীর-গহন দায়বোধের প্রমাণ। তাঁর জীবন ও কাজ জাতির সংগ্রামী অস্তিত্বের নোঙরটা শক্তিশালী করতে প্রেরণা জোগাবে। বাংলা একাডেমি ও একুশে পদকের মতো পুরস্কার তিনি পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন সম্মান ও ভালোবাসা। আমৃত্যু তিনি সেই সম্মান বাঁচিয়ে চলতে পেরেছেন।

১৯২৮ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্ম নেওয়া মানুষটি জন্মের ‘দেশ’ ছেড়ে এসে আরও অনেকের সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন নতুন স্বদেশ নির্মাণে। সেই স্বদেশ, দুবার দুই রাষ্ট্রের নিগড় ভেঙে বেরিয়ে আসার পর যে রাষ্ট্র আমাদের অবলম্বন হলো, সেই রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকদের বড় অংশটাকেই ‘সতিনের সন্তান’ জ্ঞান করে, তখন আবারও নতুন করে শুরু করার কথা ভাবতে হয়। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের জীবন ও রচনা তার কিছু পুঁজি জোগাতে পারে। তাঁর একটি বইয়ের নাম স্বাধীনতার দায়ভার। পুরোনো কথা, কিন্তু নতুন করে ভাবায়।

নিজেকে নিয়ে পরিহাস যাঁরা করেন, তাঁদের মনে চাপা এক রাগ ও অভিমান থাকে। যেন নিজেকে তুচ্ছ করে অন্যকে শেখানো। নিজের মৃত্যু নিয়ে শেষ দেখায় খুব হাস্যরস করেছিলেন। যেন ওই এক্সিমো কবির কবিতার মতোই তিনি ভাবছিলেন:

‘বরফে ভেঙে পড়েছে আমার স্লেজগাড়ি

আর আমার হাসি পাচ্ছে,

ও মন তুমি হাসো কেন?’

অভাজন আমরা শুধু তাঁর হাসিটাই দেখেছি, কান্না দেখিনি।

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

faruk.wasif@prothomalo.info