Thank you for trying Sticky AMP!!

আপনি কি কর্মক্ষেত্রে এমন যৌন বৈষম্যবাদী মন্তব্য করেছেন

প্রতীকী ছবি

প্রত্যেক ব্যক্তিরই কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক ও শালীন পরিবেশ প্রাপ্য। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রেই যেন নানা প্রতিবন্ধকতা এসে হাজির হয়। কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নারীদের শোনা সেক্সিস্ট (যৌন বৈষম্যবাদী) ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্য এগুলোর অন্যতম। পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেয়—এই অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশই হলো এসব সেক্সিস্ট মন্তব্য। পুরুষ সহকর্মীদের অশালীন কৌতুক নারীর কাজ, মেধা ও মর্যাদাকে খাটো করে। কর্মক্ষেত্রে কী ধরনের আপত্তিকর কথাবার্তা বলা হয়? আমি ঠিক এই প্রশ্নই করেছিলাম বেশ কিছু পুরুষ ও নারীকে। নারীরা যেসব মন্তব্য শুনেছেন, সেগুলো উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। আর পুরুষেরা এমন সব মন্তব্যের কথা বলেছেন, যা তাঁরা নিজেরাই পুরুষ সহকর্মীদের আলাপ থেকে শুনেছেন। আপনি যদি নারী সমতায় সহযোগী হতে চান, আপনার প্রতি খুব সাধারণ একটি অনুরোধ রইল: নিচের কথাগুলো নিজে কখনো বলবেন না। কাউকে বলতে দেখলে তাকে থামিয়ে দেবেন। 

নারীদের যৌন বস্তুর কাতারে নামিয়ে আনা

‘আমার নারী সহকর্মী যা-ই বলেন, আমার পাশের পুরুষ সহকর্মী তা ফের এমন বিকৃত ভঙ্গিতে বলেন যেন নারীরা আমাদের যৌনদাসী।’

‘আমি বিয়া করছি দেইখা ও বাঁইচা গেল, না হলে ওরে দেখায়ে দিতাম এক চিপায় নিয়া।’

আমাদের উপমহাদেশে চলচ্চিত্র, নাটক বা গানে পুরুষকে চিত্রায়ণ এমনভাবে করা হয় যেন নারীর ওপর তাঁদের একধরনের যৌন কর্তৃত্ব রয়েছে। তাঁরা নারীদের কাছে যৌনতা দাবি করতে পারেন, অনুমতি ছাড়া তা পেতেও পারেন। এমনকি তাঁদের দমিয়ে রাখতে যৌন সহিংসতারও আশ্রয় নিতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন ইঙ্গিতবাহী যেসব কটূক্তি করা হয়, তা হলো নারী সহকর্মীদের ওপর পুরুষের ক্ষমতা খাটানোর ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। 

মাতৃত্বকালীন ছুটি

‘নতুন বিয়ে করা মেয়েদের চাকরিতে নেবেন না। কিছুদিন পরেই বাচ্চা নেবে এবং বাসায় বসে থাকবে। তখন আপনাকে তার খরচ দিতে হবে।’

‘একটা ছেলেকে চাকরি দেব, অন্তত সে তো বাচ্চা প্রসব করবে না।’

এই কথাগুলো কেবল কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও হতো। কিন্তু নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে গিয়ে বা ছুটি নিতে পারেন বলে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ নারী শ্রমিকদের জন্য ১২ সপ্তাহের সবেতন ছুটির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাঁরা অফিসে কোনো প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনার কাজে জড়িত, তাঁদের বেলায় এই নিশ্চয়তা প্রযোজ্য নয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হলে তাঁর কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। সুতরাং, নারীদের চাকরি হারানো বা পদোন্নতির মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন কেবল আপনিই। বহু দেশে অবৈধ এই অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে আপনাকেই।

স্বামী, স্বামী, স্বামী

‘আপনার স্বামী তো বিরাট বড়লোক! আপনি কেন টাকার পেছনে ছুটছেন?’

‘আমি যখন আমার ব্যবসা শুরু করলাম, তখন কেউ কেউ বলল যে আমি আমার স্বামীকেই চালাতে পারিনি (আমি ডিভোর্সড), ব্যবসা চালাব কীভাবে?’

‘আপনি এত রাত পর্যন্ত কাজ করেন? আপনার স্বামী তো দেখি খুবই উদার।’

কিছু লোকের জন্য বিষয়টি উপলব্ধি করাই কঠিন যে নারীরাও প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন মানুষ। তাঁরাও নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। পুরুষেরা যেসব কারণে কাজ করেন, অর্থাৎ পরিবারের ভরণপোষণ, আর্থিক স্বাধীনতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সন্তুষ্টি, ঠিক সেসব কারণেই নারীরা কাজ করেন। নারীর প্রতি ‘স্বামীসংক্রান্ত’ কোনো মন্তব্য করার আগে একটি সহজ পদ্ধতি মনে রাখতে পারেন। আপনি কি একই মন্তব্য কোনো পুরুষকে করতেন? যদি আপনার উত্তর ‘না’ হয়, তাহলে দয়া করে সেই মন্তব্য কোনো নারীর উদ্দেশেও করবেন না। 

যোগ্যতা 

‘আরে, সে তো একটা ..., বসের সঙ্গে ঘুমায় বলে প্রমোশন পাইল। এইটা তো আমার পাওয়ার কথা ছিল।’

‘আপনি মজা করছেন? প্রকৌশল বিভাগের জন্য একজন নারী নিয়োগ দিতে চান! টেকনিক্যাল কাজের কী বোঝে সে?’

‘পুরুষেরা নারীদের তত্ত্বাবধানে থাকতে চান না। তাঁদের ধারণা, তাঁরা (নারীরা) কম পারদর্শী।’

আমাদের সমাজে পুরুষকে নারীর চেয়ে বেশি যোগ্য হিসেবে দেখানো হয়। ফলে কোনো সফল নারীর সম্মুখীন হলে অনেক পুরুষ অবচেতন মনে হুমকি বোধ করেন। তখন ওই নারীর সাফল্যের ভিন্ন কারণ (‘সে তো ...’) খুঁজে বের করেন, কিংবা স্রেফ অস্বীকার করেন যে ওই নারী দক্ষ। কিন্তু টেকনিক্যাল বা নেতৃত্বস্থানীয় পদে পদোন্নতি না পেলে অনেক নারীর ক্যারিয়ারের অগ্রগতি থমকে যায়। সুতরাং, কোনো পেশাদার সুযোগের ক্ষেত্রে একজন নারীকে বাদ দেওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, এর কারণ তাঁর যোগ্যতা না–থাকা, নাকি তাঁকে নিয়ে ইনসিকিউরিটি বোধ করা। 

শরীর নিয়ে তাচ্ছিল্য

‘তুমি এত সুন্দর একটা মেয়ে। এই কয়েক কিলো বাড়তি ওজন ছাড়া কোনো সমস্যাই নেই। একটু ব্যায়াম করলেই কমে যাবে।’

এক লোক ওয়ার্কশপ শেষে এক পাশে ডেকে নিয়ে বলে, ‘আপনি এখানে ওড়না ছাড়া থাকতে পারবেন না।’

কোনো কোনো পুরুষের ভাবই এমন যে নারীর শরীর নিয়ে মন্তব্য করা যেন তাঁদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। এই প্রত্যাশাও কাজ করে যে নারীকে তাঁর চেহারা বা বেশভূষা দিয়ে আশপাশের সবাইকে সন্তুষ্ট রেখে চলতে হবে (‘মুখে হাসি রাখো, নিচু স্বরে কথা বলো’)। রাস্তায় এই ধারণাটার বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিস দেওয়া কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের মাধ্যমে শ্লীলতাহানিতে। কিন্তু অফিস কক্ষে এই আচরণ আসে নারীর শরীর নিয়ে তাচ্ছিল্য করা (বডি শেমিং) বা ইঙ্গিতবাহী প্রশংসার আকারে। 

উপসংহার

‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না তোমাকে কেউ এসব বলেছে! তুমি জবাব দাওনি কেন?’

বাস্তবে যখন কোনো নারী অপমান বা অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা শোনেন, তখন তিনি গিয়ে ওই লোকের মুখের ওপর প্রতিবাদ করবেন, এমনটা আশা করা ঠিক নয়। কারণ, ওই লোক হয়তো খোদ তাঁর চাকরি বা সুযোগ-সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখেন। আপনি যদি আপনার নারী সহকর্মীদের জন্য একটি নির্মল কর্মস্থল চান, তাহলে আপনাকেই এই লড়াইয়ে নামতে হবে। সেক্সিস্ট মন্তব্য যখন করা হয়, তখন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করুন। কিংবা পরে ওই ব্যক্তির কাছে ই–মেইল পাঠান, কেননা তিনি হয়তো জানেন না যে তাঁর আচরণ ভুল। যদি এরপরও তাঁর এমন আচরণ চলতে থাকে, তাহলে মানবসম্পদ বিভাগে ও জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বকে অবহিত করুন। খুব গভীরে প্রোথিত কোনো আচার পরিবর্তন করা সহজ নয়, তবে পরিবর্তনের শুরুটা হতে হবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্য থেকেই। 

শাম্মী কুদ্দুস গুগলের একজন পণ্য ব্যবস্থাপক। ওয়াটারহেলথ বাংলাদেশ-এর সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও জিওন-এর ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের সাবেক প্রধান