Thank you for trying Sticky AMP!!

আফগানদের শায়েস্তায় পশ্চিমারা খাদ্যসংকট চাপিয়ে দিয়েছে

ঘরবাড়ি হারিয়ে কাবুলের পার্কে আশ্রয় নেওয়া আফগানরা রুটি সংগ্রহ করছেন

শীত যতই ঘনিয়ে আসছে, আফগানদের খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা ততই বাড়ছে। হু হু করে আফগান শহরগুলোতে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। টাকা দিলেও খাদ্য মিলছে না অধিকাংশ সময়। সাধারণ মানুষের হাতে টাকাও নেই। যে যা পারছে, বিক্রি করে খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করছে। অনেকের ধারণা ছিল, আফগানিস্তানের যুদ্ধ বুঝি শেষ। মার্কিন সৈন্য বাড়ি চলে গিয়েছে। তালেবানরা ফের আফগানিস্তান দখলে নিয়েছে। সবকিছু আগের মতোই চলবে।

তালেবানদের পুরো কর্তৃত্ব আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ কথা সত্য। শুরুর দিকে পানশিরের প্রয়াত নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলের নেতৃত্বে কিছুটা প্রতিরোধ করা হলেও, পুরো আফগানিস্তানে এখন তালেবানদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় তালেবানদের হাতে নেই। এর মধ্যে অন্যতম, জনসাধারণের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো তলানির শেষে এসে ঠেকে যাওয়া অর্থনীতির আফগানিস্তানে সবার জন্য খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সহজ বিষয় না।

আফগানিস্তানের খাদ্যসংকট বৈশ্বিক রাজনীতি বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। আফগানিস্তানের খাদ্যসংকট কৃত্রিম এবং আরোপিত। তালেবানদের শায়েস্তা করার একটি কৌশলমাত্র। একইভাবে আফ্রিকানদের শায়েস্তা করা হয়েছিল গত শতকে। আফ্রিকা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এখনো দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও খাদ্যসংকটে ডুবে আছে আফ্রিকানরা। তবে তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের অবস্থা আফ্রিকার মতো না-ও হতে পারে। মিত্র রাষ্ট্রগুলো থেকে কিছু খাদ্য সহায়তা পাবে তালেবানরা। আর উইঘুরদের উসকানি না দিলে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে চীন। অন্যথায় এই সংকট দীর্ঘায়িত হবে। খাদ্যসংকট সৃষ্টি করে শায়েস্তা করার কৌশল আবার ফিরে আসবে।
জাতিসংঘ সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়েছে, আফগানদের জরুরি খাদ্য সহায়তা দেওয়া না হলে কয়েক মিলিয়ন মানুষ খাদ্যসংকটের মুখে পড়বে। দুর্ভিক্ষের কথা জাতিসংঘ সরাসরি বলছে না। তবে অনেকেই এ ধরনের পরিস্থিতির শঙ্কা করছেন।

আফগানিস্তানে কমপক্ষে ২২ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যের সংকটের মুখে আছে। ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে দেশটি। অথচ আফগান অর্থনীতি পুরোপুরি বিদেশি সহায়তানির্ভর। আফগান জিডিপির ৪০ শতাংশ বিদেশি সহায়তা থেকে আসে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, কোনো দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ বিদেশি সহায়তা থেকে এলে সেটি ‘দাতানির্ভর দেশ’ হিসেবে বিবেচিত হয়।

খাদ্যসংকট তৈরি করে প্রতিপক্ষকে দমানো অনেক পুরোনো কৌশল। যুদ্ধের ময়দানে কুলিয়ে উঠতে না পেরে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করলেও শেষ অস্ত্র হিসেবে নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি প্রয়োগ করেছে তালেবান সরকারের ওপর। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভয়াবহ খাদ্যসংকট হওয়ার কথা নয়। যুদ্ধ ছাড়া ওই অঞ্চলে এমন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি যে খাবার নিয়ে চারদিকে হাহাকার শুরু হবে।

তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তার প্রবাহ থমকে আছে। উপরন্তু বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ আফগান সরকারের বিদেশে গচ্ছিত সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ। ফলে তালেবান সরকার বিদেশে গচ্ছিত তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না। বিবিসি জানিয়েছে, অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন আটকে আছে। ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন না। অনেকেই খাদ্যের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। সেপ্টেম্বরে মাত্র ৫ শতাংশ আফগানের হাতে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ছিল। সেপ্টেম্বরে জেনেভায় দাতাদের বৈঠকে এক বিলিয়ন ডলারের জরুরি খাদ্য সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্ব খাদ্য সংস্থার হাতে এক-তৃতীয়াংশ সহায়তাও পৌঁছায়নি। এই হচ্ছে আফগানিস্তানের খাদ্য নিরাপত্তার সবশেষ পরিস্থিতি।

খাদ্যসংকট তৈরি করে প্রতিপক্ষকে দমানো অনেক পুরোনো কৌশল। যুদ্ধের ময়দানে কুলিয়ে উঠতে না পেরে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করলেও শেষ অস্ত্র হিসেবে নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি প্রয়োগ করেছে তালেবান সরকারের ওপর। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভয়াবহ খাদ্যসংকট হওয়ার কথা নয়। যুদ্ধ ছাড়া ওই অঞ্চলে এমন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি যে খাবার নিয়ে চারদিকে হাহাকার শুরু হবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে বিভিন্ন দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন স্থগিত রেখেছে।

এ কারণে আফগান মুদ্রা ও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। আফগান ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের নগদ অর্থ দিতে পারছে না। আমদানি মূল্যও পরিশোধ করতে পারছে না। এমনকি অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করা হলেও নগদ মুদ্রা দিতে পারছে না। আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল আটকে দিয়ে আমদানির পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিদেশে রক্ষিত তহবিলের ওপর তালেবান সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় খাদ্য আমদানির মূল্য ডলারে পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য আমদানি কমে আসায় বাজারে খাদ্যসংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বরং চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আফগানদের অধিক মূল্যে খাদ্য কিনতে হচ্ছে।

খাদ্যের কৃত্রিম সংকট গত শতকে ৬০ ও ৭০-এর দশকে আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে আফ্রিকার সাব সাহারা ও দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। ওদের জমি ছিল, কৃষি ছিল, কিন্তু উৎপাদন ছিল না। যদিও ওই সময় বিশ্বে খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল। ভূরাজনীতি ও বিশ্বরাজনীতির জটিল ও কুটিল কৌশলের কারণে আফ্রিকানদের খাদ্য দেওয়া হয়নি। খাদ্যসংকট ও সংঘাত থেকে আর বের হতে পারেনি আফ্রিকা। জাতিগত সংঘাত, সম্পদ নিয়ে হানাহানির শেষে এখন ধর্মীয় উগ্রবাদ আফ্রিকাতে বিস্তার লাভ করছে। ভিন্ন ভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণ থাকলেও খাদ্যসংকট এখনো বিদ্যমান আফ্রিকার জনসাধারণের মধ্যে। এ মুহূর্তে পূর্ব আফ্রিকার দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার ২১ মিলিয়ন মানুষের জরুরি খাদ্য সহায়তা দরকার। আফ্রিকার দেশগুলোতে বিদেশি শক্তির আগ্রাসনের প্রয়োজন হয়নি। মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্যসংকটে তারা এখনো বিপর্যস্ত।

সেই একই কৌশল আফগানিস্তানের ওপর পশ্চিমারা প্রয়োগ করছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে। ক্রমাগত খাদ্যসংকট অব্যাহত থাকলে আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা বাড়বে। এমনিতেই আফগানিস্তানে নিয়মিতই সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। এর সঙ্গে খাদ্যসংকট যুক্ত হলে বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল ও উপদলের মধ্যে সংঘাত বৃদ্ধি পাবে। কোনোভাবে যদি আফগানিস্তানে আরও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা যায়, তবে এবার ভিন্ন কায়দায় দেশটি দখল করা হবে। মানবিক সহায়তার নামে বেসামরিক উপায়ে পশ্চিমারা এসে আবারও জেঁকে বসতে পারে। এখন যেমনটা হচ্ছে আফ্রিকায়। কার্যত আফ্রিকা স্থানীয় জনসাধারণ দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে হবে। কিন্তু ওদের জীবনমানের কোনো উন্নতি নেই। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের তহবিল বিনিয়োগ করেও আফ্রিকা থেকে পুরোপুরি দারিদ্র্য হটানো যায়নি। মারামারি, সংঘাত কমেনি। অথচ মানবিক সহায়তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি এনজিও আফ্রিকায় কাজ করে। জাতিসংঘের বাহিনী বিভিন্ন দেশে মোতায়েন রয়েছে শান্তি রক্ষার জন্য। কিন্তু শান্তি আসেনি।

আফগানিস্তানেও শিগগির শান্তি নাও আসতে পারে। তবে মিত্রদের সহায়তা নিয়ে তালেবানরা যদি পরিস্থিতি দক্ষভাবে মোকাবিলা করত পারে, তাহলে আফগান যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হবে। সামরিক পর্ব শেষে আফগান যুদ্ধ এখন বেসামরিক পর্বে প্রবেশ করেছে। সামরিক আগ্রাসন আফগানিস্তানে ব্যর্থ হয়েছে। এখন যদি সামাজিক ও খাদ্যের রাজনীতিও ব্যর্থ হয় তবে যুদ্ধ শেষ হবে এবং বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্যের পরিবর্তনে নতুন মাত্রা যোগ হবে। আফগান যুদ্ধের ভিত্তিতে ভারসাম্য পুরোপুরি বদলাবে, বলা যাবে না। অনেক দিন ধরেই বলাবলি হচ্ছে, বিশ্বরাজনীতির ভরকেন্দ্র নতুন এক অক্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আফগান যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করবে, ভারসাম্যের পরিবর্তন হয়ে নতুন অক্ষের উদয় ঘটছে, নাকি ঘটছে না।

মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক