Thank you for trying Sticky AMP!!

আমরা যখন 'অরিত্রী' ছিলাম

ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের আলোড়িত করেছে। পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার কারণে তাকে স্কুল থেকে টিসি দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। স্কুলে ডেকে পাঠানো হয়েছিল তার মা–বাবাকে। সবাই মিলে ক্ষমা চেয়েও ফল মেলেনি। অরিত্রী বাসায় ফিরে নিজের ঘরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। তার বন্ধুরা বলছে, শিক্ষকদের ‘নির্মম আচরণ’–এ মর্মাহত হয়ে অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে।

এই মর্মান্তিক ঘটনাটি আমার বিদ্যালয়জীবনের দিনগুলোর স্মৃতি জাগিয়ে তুলল। কেমন ছিল আমাদের সেই সব দিন!

আশির দশকের মাঝামাঝি, আমি নবম শ্রেণিতে। আমি তখন ‘অরিত্রী’। ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমাদের বড় আপা ‘ফুলরানি সরকার’। স্কুলে ক্লাস চলছে, বড় আপা বিরাট করিডর দিয়ে হেঁটে সব শ্রেণিকক্ষে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন আর একটা মুচকি হাসি ছুড়ে দিচ্ছেন। আহা! সেই হাসি আমাদের জাদুর মতো আকর্ষণ করত। আমরা বড় হয়ে ফুলরানি সরকারের মতো হব, এটাই কল্পনা করতাম। বড় আপার হাসি, কথা বলা, প্রজ্ঞা, ধীরস্থিরতা, শাড়ি পরার স্টাইল, মাথায় বেলি ফুলের মালা জড়িয়ে রাখা—সবকিছু আমাদের মোহমুগ্ধ করে রাখত।

আমাদের নবম শ্রেণির এক ছাত্রী প্রেম করল, স্কুল গেটে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা গেল তাকে। বড় আপার কাছে নালিশ এল, উনি মেয়েটির সঙ্গে কথা বললেন। ‘আরে প্রেমে পড়ার বয়সই তো এটা’—এভাবেই কাউন্সেলিং শুরু করেছিলেন তিনি সেদিন ছাত্রীটিকে। সেই ছাত্রীর অভিভাবক পর্যন্ত প্রেমের খবর পৌঁছায়নি, বড় আপাই বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন, নবম শ্রেণির প্রেমে কীভাবে লাগাম ধরতে হয়। ধন্য ফুলরানি সরকার। আমরাও আজীবন ধন্য এমন প্রধান শিক্ষক পেয়ে। পরীক্ষা খারাপ হয়েছে? বড় আপার সঙ্গে একটু কথা বলে বাসায় যাই, মন ভালো হবে। কোনো কারণে টেনশন? বড় আপাকে বলি, উনি একটা পথ বলে দেবেন। টিফিন পিরিয়ড শেষে ঘর্মাক্ত হয়ে শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছি, বড় আপার সঙ্গে দেখা, শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিলেন।

কৈশোরে এমন একজন বন্ধু পাওয়া কী যে সৌভাগ্যের, তা তখনো বুঝেছি, এখন আরও ভালো বুঝি। স্কুল শেষে কলেজে গেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর জীবনের বিশাল রাজপথে চলা, কিন্তু ফুলরানি সরকার হারাননি আমাদের মন থেকে। এখনো স্কুলের পুরোনো ছাত্রীরা বড় আপার টানে তাঁকে উপলক্ষ করে এক হই। তাঁর সঙ্গে একটু সময় কাটাব—এ যেন এখনো এক পরম পাওয়া, এক পরম ভালোবাসার বন্ধন। দেশে–বিদেশে তাঁর ছাত্রীরা ছড়িয়ে আছে, তারা ফেসবুক মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলেছে, গ্রুপের নাম ‘আমাদের বড় আপা’। সে গ্রুপে ফুলরানি সরকারও যুক্ত আছেন ছাত্রীদের সঙ্গে। ছাত্রীদের ছেলেমেয়েরাও তাঁকে চেনে, তিনি তাদেরও পরম পূজনীয়।

যে সময়টায় মানুষ রঙিন হতে শেখে, ভুল করতে করতে সঠিক পথ চিনতে শেখে, সেটাই নবম-দশম শ্রেণি। সে বয়সে ফুলরানি সরকারের মতো প্রধান শিক্ষক প্রয়োজন, যিনি ছাত্রীকে বোঝাবেন, ‘এটা ভুল করারই বয়স, ভয় নেই, এ ভুল থেকেই তুমি শিক্ষা নেবে।’ ছাড়পত্র দেওয়া কোনো সমাধান নয়, এতে ছাত্রীর ভুল সংশোধন হবে না, সে পথ হারিয়ে ফেলবে। অরিত্রীর দুর্ভাগ্য, ফুলরানি সরকারের মতো প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে এ জীবনে তার দেখা হয়নি, দেখা হলে অরিত্রী জানত, নবম শ্রেণির ভুলে কেমন করে লাগাম টানতে হয়।

আমাদের ছেলেমেয়েরা নির্দ্বিধায় আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর এখন। তাদের আছে প্রযুক্তি, অনেক আধুনিক তারা, বিশ্ব তাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় শঙ্কার কথা হলো, তারা আজ অনিরাপদ। জিপিএ–৫–এর ইঁদুর দৌড়ে তারা শুধু দৌড়াচ্ছে, পিএসসি-জেএসসি—সব ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটাই তারা জানতে পারছে না। জীবন মানে শুধু ইঁদুর দৌড় নয়, জীবন মানে শুধু জিতে আসা নয়, জীবনে হারতেও শিখতে হয়, ভুল করতে করতে সত্যটাকে জানতে শিখতে হয়। জীবন অনেক বড়; ভুল করে জীবন শেষ করে দেওয়ার নাম জীবন নয়।

আমাদের শিক্ষানীতি, শিক্ষাপদ্ধতি, কোচিং–বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে কত কথা হয়, কখনো তো শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে কথা হয় না। স্কুলের শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের আদর্শ না হয়ে প্রতিপক্ষ হয়ে যাচ্ছেন—এ বিষয় কারও নজরে পড়ছে না। ভুল করার শাস্তি আরেকটা বড় ভুলের মধ্য দিয়ে শেষ হলো, এ বড় লজ্জার, বড় বেদনার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘পুণ্যে-পাপে দুঃখে-সুখে পতনে-উত্থানে, মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।’ আমাদের বড় আপাও বলতেন, ‘জীবনে হোঁচট খেয়েই আবার ঘুরে দাঁড়াবে, কখনো পড়ে যাবে না। হোঁচট খেতে খেতেই দাঁড়াতে শিখতে হবে।’ এখনো কথাগুলো কানে বাজে। তিনি সব সময় বলতেন, ‘আমার সোনার মেয়েরা।’ ভালো ছাত্রী–মন্দ ছাত্রী কোনো ভেদাভেদ করেননি তিনি, সবাই তাঁর সোনার মেয়ে। তাঁর স্পর্শে তাই তামাও একসময় সোনা হয়ে গেছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকেরা আরও ধৈর্যশীল হবেন, সহনশীল হবেন, শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের সঙ্গে প্রভু বা প্রতিপক্ষসুলভ নয়, বন্ধুসুলভ আচরণ করবেন। সেরা স্কুল বিচারের জন্য শুধু ছাত্রছাত্রীর ভালো ফলাফল আর শতভাগ পাসের হার নয়, এর পাশাপাশি শিক্ষকদের শিক্ষকসুলভ আচরণ, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, ধৈর্যশক্তি, সততা আর ন্যায়নিষ্ঠাও মানদণ্ডে আনা প্রয়োজন এখন। ছোট ভুলের পরিণতি যেন বড় পাপ না হয়, সে দায় সবারই।

ড. কাশফিয়া আহমেদ, কৃষিবিদ, উইন ইনকরপোরেট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী।