Thank you for trying Sticky AMP!!

আমাদের আবেদ ভাই

স্যার আবেদের ‘উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা’র মডেল সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে না ফেরার দেশে চলে গেলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ, যিনি দেশ-বিদেশের অগণিত বাংলাদেশির কাছে ‘আবেদ ভাই’ হিসেবেই পরিচিত। তাঁর অনেক অনুসরণীয় কর্মকাণ্ড ও অসংখ্য কীর্তিগাথা আজ সবার মুখে মুখে ফিরছে। কিন্তু আমরা অনেকেই অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর এই ক্ষণজন্মা মানুষের নিজেরই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার অনেক ইতিহাস জানি না।

সালটা ঠিক মনে নেই, আশির দশকের শেষ দিকে একজন নবীন গবেষক হিসেবে মাঠের অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত একটি এলাকা শাল্লায় গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল মাঠপর্যায়ে বেসরকারি সংগঠন বা উদ্যোগগুলো কীভাবে বিকাশ লাভ করছে, সে সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করা। কিন্তু মনের মধ্যে আরও একটি প্রত্যাশা ছিল ফজলে হাসান আবেদ নামের একজন উন্নয়ন সংগঠকের সাক্ষাৎ পাওয়া। শুনেছিলাম তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে আরাম-আয়েশের করপোরেট কর্মকর্তার চাকরি ও নগরীর সচ্ছল জীবন অবলীলায় ত্যাগ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্রতী হয়েছেন। শাল্লার নিভৃত পল্লিতে তাঁর স্বপ্ন, মেধা ও মননের বিকাশ ঘটেছিল এমন একটি বীজ বপনের মাধ্যমে, যা আজ পুষ্পে-পল্লবে বিকশিত হয়ে মহিরুহের আকারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের মর্যাদায় আসীন।

কয়েক দিন ছিলাম শাল্লার সেই গ্রামে, কিন্তু আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়নি। তিনি তখন ঢাকায়, তবে তাঁর সহকর্মীরা আমাকে ‘মারকুলি’র যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেটি দেখিয়েছিলেন। সাদামাটা ঘর, হারিকেনের আলোতে রাতে কাজ করতে হয়।

সেদিন শাল্লায় ব্র্যাকের ‘উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা’(এনএফপিই) কর্মসূচি দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম। এক গৃহস্থবাড়ির আঙিনায় একজন শিক্ষক ২৫-৩০টি শিশুকে নিয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রটি পরিচালনা করছেন। এদের বয়স ৮ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, আঙিনায় চাটাইয়ে বসে মহানন্দে শিশুরা লেখাপড়া করছে, আশপাশের কয়েকটি বড় গাছে কিছু গরু-ছাগল বাঁধা! আমার সহযাত্রী ব্র্যাকের এক কর্মী বলেন, যেহেতু এসব শিশুকে বাড়ির গবাদিপশুকে মাঠে চরাতে নিয়ে যেতে হয়, সেহেতু তাদের স্কুলে আনতেও নিষেধ করা হয় না! এমনকি কেন্দ্রগুলো ছুটি হয়ে যাওয়ার আগে প্রতিদিন শিক্ষক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে জেনে নেন পরের দিন তারা কখন, কোন সময়টাতে পড়তে আসতে চায়। অবাক বিস্ময়ে উপলব্ধি করলাম, কীভাবে ব্র্যাক আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার চাহিদা তৈরি করে চলেছে!

আজ আর কারও বাড়ির আঙিনায় শিক্ষাকেন্দ্র চালানোর প্রয়োজন হয় না, শিক্ষার্থীদের গবাদিপশু নিয়ে স্কুলে আসতে হয় না, স্কুলের সময়ের হেরফের করারও তেমন প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশের জনমানুষের মধ্যে সর্বস্তরে শিক্ষার যে চাহিদা আজ তৈরি হয়েছে, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে এ দেশ যেভাবে এগিয়েছে, তার পেছনে স্যার আবেদের ‘উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা’-এর মডেল যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে, তা স্বীকার করতেই হবে।

এগুলো দেখে তখন থেকেই মনের মধ্যে শখ ছিল, আশা ছিল, নিশ্চয় শিগগিরই ফজলে হাসান আবেদের দেখা মিলবে। দেখা হলো নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময় স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে উত্তাল সংগ্রামে যখন তোলপাড় রাজধানীসহ সারা দেশ। নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষ তখন আন্দোলনে। একপর্যায়ে দেখলাম স্বৈরাচারী সরকারের পতন, তিন জোটের রূপরেখায় স্বাক্ষরদানকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগ দিলেন আবেদ ভাই, সামাজিক নেতৃত্বের পুরোধা হিসেবে। সেই সুবাদে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে। তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা, দেশ ও মানুষের জন্য প্রগাঢ় মমত্ববোধ, নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কাজ করার অসীম আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করল।

দীর্ঘ আড়াই দশকের বেশি সময় উন্নয়নজগতে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কী অসম্ভব ঠান্ডা মাথায় কত প্রতিকূল পরিবেশ উত্তরণ করে কত কঠিন কাজ তিনি সম্পাদন করেছেন। কখনো সহকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, কখনো নিজের হাতে হাল ধরেছেন, কখনোবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়েছেন।

আমি কখনো আবেদ ভাইকে থেমে যেতে দেখিনি। সৃষ্টিকর্তা তাঁকে যে প্রাণশক্তি দিয়েছিলেন, যে মেধা তিনি চর্চা করেছেন, যে মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন, সে জন্য তিনি চিরদিন আমাদের কাছে বিশেষ করে উন্নয়নকর্মীদের কাছে একজন ‘রোল মডেল’ হিসেবে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আজকের বাংলাদেশ শুধু দেশেই নয়, বাইরের দুনিয়ার কাছেও এনজিও খাতের উর্বর, গতিশীল ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। এ দেশে নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে নারী উন্নয়নের যে ধারা বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করেছে, তার পেছনে ব্র্যাকের প্রাণপুরুষ স্যার ফজলে হাসান আবেদের অবদান অনস্বীকার্য।

বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর অনেক সফল নারী আজ নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের অধিকাংশ আবেদ ভাইয়ের হাতে গড়া—এটা বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি নিজে শুধু সামনে এগিয়ে যাননি। আরও অনেক মানুষকে এ দেশের গণমানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।

মনে পড়ছে, বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত সহস্রাধিক বেসরকারি সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ঐক্যজোট গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসনের দায়িত্ব অনেক দিন পালন করেছেন আবেদ ভাই। কিন্তু একবার বার্ষিক সাধারণ সভায় বেঁকে বসলেন তিনি। বললেন, ‘আমি আর চেয়ারপারসন থাকতে চাই না, প্রতিবার একই ব্যক্তি এ ধরনের ঐক্যজোটের প্রধান নির্বাচিত হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়, এটি অগণতান্ত্রিক। এবার নতুন নেতৃত্ব আসুক।’ কিন্তু সাধারণ সভায় উপস্থিত অনেক নারী সদস্য একজোট হয়ে আবেদ ভাইকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকলেন, তাঁরা তাঁর মুখ থেকে ‘না’ শুনতে রাজি নন। সেদিন বিব্রত হয়েছিলেন স্যার আবেদ, কিন্তু সমবেত নারী প্রতিনিধিদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে শুধু আরও একটি মেয়াদে চেয়ারপারসন থাকতে রাজি হয়েছিলেন। সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিশ্চিত হয়েছিলাম আমি। কারণটা বলার অপেক্ষা রাখে না, স্যার ফজলে হাসান আবেদ যেখানে নেতৃত্ব দেবেন, সেখানে অবশ্যই গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে।

গত নভেম্বরের শুরুর দিকে আবেদ ভাইকে দেখতে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি তখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী। এমন অবস্থায় তাঁকে দেখে অভ্যস্ত নই, তাই কান্না পাচ্ছিল। তিনি কাছে ডাকলেন, বললেন, ‘শিক্ষায় কাজ করে যাচ্ছ, অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে, কিন্তু হাল ছেড়ো না কখনো।’ মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষ নিজের শারীরিক অবস্থা, দুঃখ–কষ্ট কোনো কিছু নিয়ে কথা না বলে শিক্ষায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ জোগাচ্ছেন, এ শুধু আবেদ ভাইয়ের পক্ষেই সম্ভব!

স্বাধীনতার পর থেকে গত সাড়ে চার দশকে আবেদ ভাই কত সংগঠন গড়ে তুলেছেন, কত নেতৃত্ব তৈরি করেছেন, কত লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার সন্ধান দিয়েছেন, কত অগণিত মানবসন্তানকে শিক্ষার আলো দিয়েছেন, সুস্বাস্থ্যের সন্ধান দিয়েছেন, তার অনেক হিসাব হয়তো মিলবে ব্র্যাকের অসংখ্য নথিপত্রে, দেশ-বিদেশের বহু শুভানুধ্যায়ীর কাছে। কিন্তু স্যার ফজলে হাসান আবেদের অসংখ্য কীর্তিগাথা, অনেক অনুসরণীয় কাজ, অনেক কিছু হয়তো দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাবে চিরদিন। প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী, উন্নত স্বদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা এই কর্মবীর চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমার মতো অনেক উন্নয়নকর্মী, যাঁদের কাছে তিনি শুধু পিতৃতুল্যই নন; স্মরণীয়, বরণীয় একজন আলোকিত মানুষ, আমরা তাঁর আলোতে পথচলার ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে যাব।

আবেদ ভাই, আপনি যেখানেই আছেন, ভালো থাকুন। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে নিশ্চয়ই ভালো রাখবেন। আজ আপনার চিরবিদায়ের ক্ষণে এই আমাদের প্রার্থনা।

রাশেদা কে চৌধূরী: গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক