Thank you for trying Sticky AMP!!

আমেরিকায়ও গণতন্ত্রের সংকট!

ভোট কারচুপির অভিযোগ তাড়া করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের দেশ বলে দাবিদার আমেরিকায়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে নিউইয়র্কের রাজ্য গভর্নর পদে প্রার্থী ছিলেন অ্যান্ড্রু কুমো। কুমো পরিবার রাজনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী। তাঁকে নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন সিনথিয়া নিক্সন।

‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’ সিনেমার তারকা সিনথিয়া প্রচারে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিলেন। উদারনৈতিক নিউইয়র্কে নিজেকে সমকামী বা বহুকামী ঘোষণা দেওয়ার পরও সেখানকার জনবহুল এলাকাগুলোয় তাঁর প্রচার ছিল তুঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে উথলে পড়ে তরুণ প্রজন্ম।

নির্বাচনের দিন দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। অ্যান্ড্রু কুমোর কাছে হালে পানি পাননি সিনথিয়া। নির্বাচনের দিন বিকেল নাগাদ ফলাফল আসতে থাকে বিভিন্ন কেন্দ্রে থেকে। ফলাফলে অ্যান্ড্রু কুমোর জয়জয়কার।

সিনথিয়ার প্রচার শিবির থেকে অভিযোগ আনা হলো, ধারণার বেশি ভোটার উপস্থিতি অস্বাভাবিক ঠেকছে। নিশ্চয়ই সূক্ষ্ম কোনো কারচুপি হয়েছে কোথাও।

এখানে কিছু বললেই কেউ হামলে পড়ে না। অভিযোগের কোনো প্রমাণ আর পাওয়া যায়নি। কথিত সূক্ষ্ম কারচুপির কথা সমর্থকেরা নির্বাচনের রাতেই ভুলে যান।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ফেক মিডিয়া’ও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। বরং বলেছে, তহবিলের জোরে প্রান্তিক এলাকায়ও জোর প্রচার চালাতে পেরেছেন কুমো। ফলে, রেকর্ডসংখ্যক ভোটার উপস্থিত তাঁর বিজয়কে নিশ্চিত করেছে।

কদিন পর দেখা গেল আরেক অভিযোগ। একটি উদারনৈতিক মহল থেকে বলা হলো, কারচুপি হয়েছে অন্যভাবে। সূক্ষ্ম নয়, অতি সূক্ষ্ম। অনেকটা ‘বৈধ কারচুপি’।

আমেরিকায় নির্বাচনের দিন কর্মদিবস থাকে। এখানে ভোট দেওয়ার জন্য ছুটি নেই। নগরী থেকে বেশ কিছু নিউইয়র্কবাসীকে আগেই চিঠি দেওয়া হয়, তাঁদের বাসাবাড়ির লেড পয়জনিং পরীক্ষা করা হবে। তাই নাগরিকেরা যেন বাসায় থাকেন। সিটি থেকে ইন্সপেক্টর আসবেন।

বড় বড় নগরীতে এসব নৈমিত্তিক ঘটনা। নানা কারণে সিটি ইন্সপেক্টর বাসাবাড়ি ভিজিট করেন। এ সময় বাসাবাড়ির লোকজনকে অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে উপস্থিত থাকতে হয়। নাগরিকদের বলা হয়, তোমরা ঘরে থাকো।

এমন পরিস্থিতিতে ভোট দেওয়ার জন্য যেতেই সময় পান না অনেকে।

সিনথিয়ার পক্ষের একদল লোক বললেন, এ বিরাট কারচুপি! ষড়যন্ত্র করেই এমনটা করা হয়েছে। এমনিতেই লোকজন ভোট দিতে যায় না, তার ওপর বলা হয়েছে, সিটি থেকে লোক আসবে। ষড়যন্ত্র করে লোকজনকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে!

এই অভিযোগ তেমন পাত্তা পায়নি। কারণ, যেসব এলাকায় নগরী থেকে এমন নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, সেসব এলাকায় প্রচার জরিপে সিনথিয়া অনেক পিছিয়ে ছিলেন। ফলে তাঁদের অভিযোগ আর ধোপে টেকেনি।

২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট কারচুপি হয়েছে বলে ব্যাপক আলোচনা হয়। আমেরিকার গণতন্ত্রের সেই আদি যুগ আর নেই। এখানেও অনুপস্থিত ভোটারদের ভোট দেওয়া হয়েছে উনিশ শতকে। ‘গ্রেভ ভোটার্স’ বা কবরে শায়িত ভোটারদের ভোট দেওয়া হয়েছে কোনো কোনো সময়। চেনাজানা সব পন্থায় ভোট কারচুপির ইতিহাস আমেরিকায় ৫০ বছর আগেই সাঙ্গ হয়েছে। হালে ২০১৬ সালের নির্বাচনে ভোট কারচুপির কথা আবার ব্যাপকভাবে শুনেছেন আমেরিকার লোকজন। পরাজিত ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে যেমন কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছে, তেমনি অভিযোগ করেছেন বিজয়ী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পও।

দেখা গেল, ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও সংখ্যার দিক দিয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। অমনি ট্রাম্প অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসলেন। জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে থাকবেন বিজয়ী ট্রাম্প, তা কেমন করে হয়!

বিজয়ী ট্রাম্প বললেন, জনপ্রিয় ভোটে তিনিই বেশি ভোট পেতেন, যদি না হিলারির পক্ষে অবৈধ অভিবাসীরা ভোট না দিতেন।

এখানে ভোটার রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়ায় আইনের কড়া নজরদারি হয়। ভোটের যোগ্য নন, এমন লোক ভোট দিলে তাঁর ইমিগ্রেশন বাতিল পর্যন্ত হয়। আর কারাবাস তো অবধারিত।

যুক্তরাষ্ট্রে এমনিতেই লোকজন ভোট দিতে যান না। তার ওপর কে আবার যাবেন জাল ভোট দিতে! নির্বাচন উপলক্ষে প্রত্যেক প্রার্থী বা দলের বড় আইনজীবী প্যানেল থাকে। নির্বাচনে সামান্য হেরফের হলে তাঁদের হামলে পড়ার কথা। কিন্তু কেউ হামলে পড়েননি। ট্রাম্পের অভিযোগ তাঁর অন্য সব কথার মতোই বাগাড়ম্বর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন লোকজন।

আমেরিকার ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপে কারচুপি হয়েছে—এই অভিযোগ এখনো আছে। ‘রাশিয়া যদি আমেরিকার নির্বাচনকে উল্টেই দিতে পারে, তাহলে আমরা নিজেদের আর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ বলে কেনই-বা বড়াই করি’—এমন মন্তব্য কোনো কোনো আমেরিকানের।

যদিও কট্টর ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদীদের মতে, রাশিয়া অবশ্যই আমেরিকার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। রাশিয়ার সাহায্যেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

এসব প্রশ্ন এখনো মিলিয়ে যায়নি। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়, তা দেখার অপেক্ষায় অনেকে।

ইউক্রেনের ২০০৪ সালের নির্বাচন। ক্ষমতাসীন ভিক্টর ইয়ানোকোভিচকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তুমুল আয়োজন চলছে বিরোধী পক্ষ থেকে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন নাটকীয় নির্বাচন আর হয়নি। ভোটকেন্দ্রে লোকজনের যাওয়ার তুমুল আগ্রহ। রীতিমতো উৎসবের আয়োজন। ভিক্টর ইয়ানোকোভিচকে হটাতে সবাই উন্মুখ। সবাই ভোট দিচ্ছেন সারি ধরে। একজন একটি করে ব্যালট নিচ্ছেন। পোলিং বুথে যাওয়ার সময় ভোটের নিয়ম অনুযায়ী একটি করে ব্যালট পেপার আর কলম ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভোটার কলম দিয়ে নিজের প্রার্থীকে চিহ্নিত করে ব্যালট বাক্সে ছেড়ে আসছেন। গণতন্ত্রের জন্য দায়িত্ব পালনে ব্যাকুল নাগরিক। সুশৃঙ্খল গণতন্ত্রের এমন চর্চায় উদ্বেলিত ইউক্রেনের লোকজন। গণনার সময় দেখা গেল, ব্যালট বাক্সগুলোয় হাজার হাজার সাদা ব্যালট। কারণ, অনুসন্ধানে বেরিয়ে এল, ব্যালট পেপারে চিহ্ন দেওয়ার জন্য পোলিং বুথে সরবরাহ করা কলমের কালি এমনভাবে উৎপাদিত, যা কয়েক মিনিট পরেই আপনা-আপনি মুছে যায়!

নির্বাচনে এমন কারচুপি করেও ভিক্টর ইয়ানোকোভিচ ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। পুনর্নির্বাচন হয়েছে ইউক্রেনে। পুনর্নির্বাচনে ভিক্টর ইয়ানোকোভিচের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পুনর্নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ সবচেয়ে বেশি কারচুপি করেছে। কারচুপির এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ভিক্টর ইয়ানোকোভিচের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা সে সময় বলেছিলেন, কারচুপির যে শিক্ষা ভিক্টর ইয়ানোকোভিচের বিপক্ষের লোকজন রপ্ত করেছিল, তা তারা কাজে লাগিয়েছে বেশ ভালো করেই।

ব্রিটিশ অধ্যাপক নিক চিজম্যান ও মার্কিন রাজনীতিবিজ্ঞানী ব্রায়ান কেলাস তাঁদের সাম্প্রতিক রচনায় লিখেছেন, বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী বহু সরকার আইনের কোনো লঙ্ঘন না করেই নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে। এর নানা উদাহরণও দিয়েছেন তাঁরা। বলেছেন, সাম্প্রতিক দশকে সারা বিশ্বেই গণতন্ত্রের মান কমে যাচ্ছে।

ফ্রিডম হাউস নামক সংগঠনের মতে, বিশ্বের ৭১টি দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার দিনে দিনে সংকুচিত হচ্ছে। বিশ্বের মাত্র ৩৫টি দেশে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের অগ্রগতি ঘটছে। ২০০৬ সালের পর থেকে বিশ্বে কর্তৃত্ববাদ বাড়ছে। কমছে গণতন্ত্রের আবহ। বিশ্বের সব মানুষের তিনজনের মধ্যে দুজনের বসবাস এখন পূর্ণ গণতন্ত্র নয়—এমন পরিবেশে। বিশ্বে নাকি এখন গণতন্ত্রের মহামারি চলছে!

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণ আর কথাবার্তা আমেরিকার গণতন্ত্রকামীদের কাছেও নতুন। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর আচরণ, বিরোধীদের নিয়ে তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ দেখে আমেরিকার উদারনৈতিক বন্ধুরাও আজ বলে থাকেন, আমেরিকাও দেখা দিয়েছে গণতন্ত্রের সংকট!

ইব্রাহীম চৌধুরী: আবাসিক সম্পাদক, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণ
ibrahim.chowdhury@prothomalo.com