Thank you for trying Sticky AMP!!

আলোচনায় শুধু আ.লীগ আর বিএনপি

দেশ এখন আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে। চারদিকে নানা স্থাপনার নির্মাণকাজ চলছে। অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট। ইট-সিমেন্ট-বালু-রডের ব্যবহার বাড়ছে দিন দিন। ধুলা উড়ছে আকাশে-বাতাসে। ঢাকা নাকি এখন দূষণের ডিপো, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। উন্নয়ন চাইলে এটুকু কষ্ট তো করতেই হবে। সবগুলো প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলে আমরা তরক্কির চূড়ায় উঠে যাব। আওয়ামী লীগের নেতারা হরহামেশাই বলেন, যারা উন্নয়ন চায় না, তারাই কেবল সমালোচনা করে। যত সব বাকোয়াজ!

সরকার গোছানোর জন্য মাঝেমধ্যে মন্ত্রিসভায় রদবদল হয়। দল গোছানোর কাজটি হয় দলের কাউন্সিলকে লক্ষ্য করে। ২০-২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা হবে। এ নিয়ে জোরদার প্রস্তুতি চলছে। এ দুদিন ঢাকা শহর লীগময় থাকবে। ব্যানারে-পোস্টারে-ফেস্টুনে রাস্তাঘাট ভরে যাবে। অনেকগুলো তোরণ তৈরি হবে। গেট-কালচারে আমরা অদ্বিতীয়।

কাউন্সিল সভায় দলের নীতিনির্ধারণ হয়। আর হয় নতুন কমিটি। দলের নীতি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনা নেই। উঁচু থেকে নিচু পর্যন্ত সকল পর্যায়ের নেতারা একই সুরে ‘সোনার বাংলা’ কায়েমের কথা বলছেন। আর বলছেন বিএনপির ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, এ রকম একটা দল, যাদের প্রধান পেশা হলো ষড়যন্ত্র করা, তাদের কেন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে না।

কাউন্সিল সভায় দলের নেতৃত্বে কিছুটা পরিবর্তন আসবে বলে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ আসবে বলে বলেছেন কেউ কেউ। এখানে দুটি সম্ভাবনা আছে। যুবলীগের সদ্য নিয়োজিত চেয়ারম্যানের মতো আনকোরা মুখ দেখা যাবে, নাকি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনো একজনকে এ পদের জন্য বেছে নেওয়া হবে। সিদ্ধান্তটি নেবেন দলের সভাপতি, এটা সহজেই অনুমেয়। তবে রেসে আছেন বেশ কয়েকজন।

বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কঠিন অসুখে ভুগে আবার কাজে ফিরে এসেছেন। তবে আগের মতো চনমনে ভাবটি আর নেই। তাঁর বিশ্রামের দরকার। বড় একটা মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের বাজেটও অনেক বড়। সড়ক নিয়ে আছে নানা ঝামেলা। সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ আসার সম্ভাবনা আছে। তবে না এলেও তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। যে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা, সেখানে সাধারণ সম্পাদক কে, তা নিয়ে জটিল অঙ্ক কষার দরকার হয় না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৩ বছর। তখন সভাপতি ছিলেন মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব ছিলেন তাঁর পুত্রবৎ। কিন্তু দল ছিল সাধারণ সম্পাদককেন্দ্রিক। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব দলের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ হয়ে পড়ে সভাপতিকেন্দ্রিক দল। কর্মদক্ষতা, পরিশ্রম এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে শেখ মুজিবের এই অবস্থান তৈরি হয়েছিল।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৬৬ সালের মার্চ থেকে বাহাত্তরের এপ্রিল পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর গুছিয়ে কাজ করার খ্যাতি ছিল। যে দলে একসময় শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দীন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, সেই দলে ওই মাপের একজন সাধারণ সম্পাদক খুঁজে পাওয়ার আশা কেউ করেন না। সুতরাং এ পদে কে আসছেন কিংবা নতুন কেউ আসছেন কি না, তা নিয়ে জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, এমনটি বোধ হয় না।

দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সামনে রেখে জেলা সম্মেলনগুলো হওয়ার কথা। তবে নানা জটিলতায় সব জেলায় সময়মতো কাউন্সিল সভা করা যাচ্ছে না। সবাই নেতা হতে চান, দলে পদ চান। কমিটিতে পদের সংখ্যা বাড়িয়েও সবাইকে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। দেশে প্রতিযোগিতা করার মতো অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নেই। থাকলেও তারা ক্ষমতার রাজনীতির বৃত্তে নেই—এমনটাই মনে করে আওয়ামী লীগ। তাই আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিযোগিতা তাদের নিজেদের মধ্যেই। প্রতিযোগিতা থাকা ভালো। এতে তো দক্ষতা বাড়ার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। প্রতিযোগিতা হচ্ছে কাকে ল্যাং মেরে কে ওপরে উঠবে। সে জন্য মারামারি, খুনোখুনি হচ্ছে। এটাকে কি অন্তপার্টি সংগ্রাম বলা যাবে? নেতারা অবশ্য বলেন, বড় দলে এ রকম হয়েই থাকে। এটা বোঝা যায়, অনেকেই পদ পেতে মরিয়া। দলে একটা ‘ভালো’ পদ পাওয়া মানে ইহজাগতিক কল্যাণের পথ আরও চওড়া হওয়া।

দলের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা পদ নিয়ে হা-হুতাশ কিংবা কামড়াকামড়ি করেন না। নেত্রী যা দেবেন, তাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। তাঁদের মূল্যায়ন হয় অন্যভাবে। সভাপতি শেখ হাসিনার চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি মোটামুটি সবাইকে চেনেন, সবার অতীত-বর্তমানের হদিস রাখেন, তাঁদের চলাফেরা, কথাবার্তার সব তথ্য নানা উপায়ে সংগ্রহ করেন। কার জোর কোথায় এবং দুর্বলতা কী, এটি তিনি ভালো করেই জানেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সভা হয় তিন বছর পরপর। প্রশ্ন হলো, আগামী তিন বছরের জন্য দলের রূপকল্প কী, সরকারের জন্য তার কর্মসূচি কেমন? এ নিয়ে নিশ্চয়ই কাজ হচ্ছে। কিন্তু গণমাধ্যমে বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সরকার কি দলের নির্দেশনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে, নাকি সরকারের নির্দেশনা ও কর্মসূচি দলের ঘোষণাপত্রের কলেবর বাড়াবে? যেহেতু সরকার ও দলের প্রধান একই ব্যক্তি এবং যেহেতু সরকার ও দলে দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে কিছু নেই, তাই প্রশ্নটির জবাবে বলা যায়—নট অ্যাপ্লিকেবল, প্রযোজ্য নয়।

রাজনীতির মাঠে চলছে অসম প্রতিযোগিতা। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বলে তেমন কেউ নেই। এত দিন রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যতম ভাগীদার ছিল বিএনপি। তারা প্রায়ই বলে, সরকার একটি ‘অবাধ নির্বাচন’ দিয়ে তার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করুক। আপাতত তার সম্ভাবনা নেই। শিগগির নির্বাচন হচ্ছে বলে মনে হয় না। ২০১৮ সালের নির্বাচন কেমন হয়েছে, এ নিয়ে দুই দলের প্রকাশ্য অবস্থান বিপরীতমুখী। ঘটনা কী ঘটেছে তা জানেন ভোটাররাই। তাঁরা এখন চাল, পেঁয়াজ, রাস্তাঘাট, বায়ুদূষণ নিয়ে জেরবার।

অনেক আগে একটা ছবি দেখেছিলাম—দ্য অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর। ছবিতে একটা বাস্কেটবল খেলার দৃশ্য ছিল। দেখা গেল এক দলের খেলোয়াড়েরা বেশ লম্বা-চওড়া, গাট্টাগোট্টা, বলশালী। অন্য দলের খেলোয়াড়েরা তুলনামূলকভাবে ছোটখাটো ও দুর্বল। হাফ টাইম পর্যন্ত বলশালীরা একচেটিয়া খেলে অনেক স্কোর করে ফেলল। অপর দলের গো-হারা নিশ্চিত।

এমন সময় অকুস্থলে হাজির প্রফেসর সাহেব। তিনি ল্যাবরেটরিতে কী একটা আবিষ্কার করেছেন, একটা পেস্টের মতো। ওটা সঙ্গে থাকলে উড়ে উড়ে দূরে যাওয়া যায়। তিনি ওই পেস্টের টুকরো লুকিয়ে লুকিয়ে দুর্বল দলের খেলোয়াড়দের জুতোর নিচে লাগিয়ে দিলেন। খেলা যখন আবার শুরু হলো, সব হিসাব গেল বদলে। দুর্বল খেলোয়াড়েরা লাফ দিয়ে প্রতিপক্ষের মাথা ডিঙিয়ে তাদের বাস্কেটবল খেলতে লাগল এবং শেষমেশ একতরফা গোল দিয়ে জিতে গেল ম্যাচ। প্রফেসর সাহেবের ম্যাজিকে দৃশ্যপট আমূল পাল্টে গেল।

বিএনপি কি এ রকম একজন প্রফেসরের আশায় আছে, যিনি ম্যাজিক দিয়ে সবকিছু বদলে দিতে পারবেন!

ঘুরেফিরে আলোচনায় কেবল আওয়ামী লীগ আর বিএনপি।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com