Thank you for trying Sticky AMP!!

আড়ি পাতার অধিকার কে কাকে দিয়েছে

লোকমুখে শুনেছি, পাকিস্তান আমলে ল্যান্ড টেলিফোনের যুগে টেলিফোন কর্তৃপক্ষ নাকি একসঙ্গে মাত্র দুই জোড়া টেলিফোনের কথোপকথনে আড়ি পাততে পারত। তখন তো চোর–ডাকাতের বাসায় ল্যান্ড টেলিফোন থাকত না। এখনকার মতো জঙ্গিদের হানাহানির প্রকোপও তখন ছিল না। অবশ্য বামপন্থীদের সরকার ভয় পেত। ‘টিকটিকি’ অর্থাৎ গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখত বামপন্থী নেতাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য।

সেটা ছিল সেকাল। একালের শুরু সঠিকভাবে নির্ধারণ অসম্ভব। তবে মোটা দাগে বলা চলে, ব্যাপক আড়ি পাতা শুরু হয়েছে সম্ভবত অর্ধযুগ আগে। পাঁচ–ছয় বছরেই গতি সঞ্চারিত হয়েছে অনেক। এই আড়ি পাতা যুগের প্রথম দিকে তিন মাসে, ছয় মাসে দু–একটা আড়ি পাতা ‘ভাইরাল’ হতো। এখন এ দেশে মোবাইল ফোনের সংখ্যা নাকি মোট জনসংখ্যার কাছাকাছি। অতএব ভাইরাল হতে সময় লাগে খুবই অল্প; আর কথা ফাঁস হয়ে প্রকাশ্যে আসছে ঘন ঘন। টাটকা ভাইরালের জন্য এখন তিন–ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয় না।

কথোপকথন ভাইরাল হওয়া থেকে জন্ম নেওয়া প্রথম যে মামলার সঙ্গে আমি আইনজীবী হিসেবে জড়িয়েছিলাম, সেটা ছিল সাদেক হোসেন খোকা ও মাহমুদুর রহমান মান্নার ঘটনা। তাঁদের দুজনের ভাইরাল হওয়া কথোপকথনের এক প্রান্তে ছিলেন সেই সময়ে আমেরিকায় বসবাসরত সাদেক হোসেন খোকা। মামলাটা ছিল জবরদস্ত। অর্থাৎ তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ ছিল। মাহমুদুর রহমান মান্না জেলে ছিলেন প্রায় দুই বছর। সাদেক হোসেন খোকা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁর লাশ দেশে এনে জানাজা–দাফন করা হয়েছে; কিন্তু পুলিশ নাকি সেই কথোপকথন মামলার তদন্ত এখনো চালিয়ে যাচ্ছে।

কথোপকথনের সর্বশেষ মামলায় জড়িয়েছিলাম গত সপ্তাহে। সাংসদ মুজিবর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) সঙ্গে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কথিত টেলিফোনে কথোপকথন ভীষণ দ্রুত ভাইরাল হয়। ফলে ফৌজদারি মামলা, তারপরে জামিন ইত্যাদি। ধরে নিচ্ছি প্রথম আলোর ওয়াকিবহাল পাঠক ঘটনাটির আদ্যোপান্ত জানেন। মোদ্দা কথা, টেলিফোনে অনেকেরই কথাবার্তায় আড়ি পাতা হয়; অনেক সময় রেকর্ড করা হয়। আজকাল তো এটা একটা জাতপাতেরও ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারিভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিআইপি) না হলেও আমরা অনেকেই ধরে নিই যে আমাদের কথাবার্তায় আড়ি পাতা হয়। হয়তো রেকর্ডও করা হয়।

আজকাল সংবিধানের জন্য মায়া হয়। ১৯৭২ সালে নতুন দেশের জন্য সবার অনেক স্বপ্ন ছিল। সংবিধানে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লেখা হয়েছিল। ওয়াদা করা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল, নতুন এই বাংলাদেশে এই সবকিছু সাত–তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হবে। বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই এখনো বহুদূরে। তাই আজকাল সংবিধানের ওই কথাগুলো মনে হয় বাস্তবতাবিবর্জিত।

সংবিধানে রাষ্ট্র আমাদের বেশ অনেকগুলো মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিছু অধিকার ছিল নিঃশর্ত বা অকাট্য, অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই এর হেরফের বা বিন্দুমাত্র লঙ্ঘন হবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, এমনকি যুদ্ধের দোহাই দিয়েও এই সব অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না। যেমন ‘নির্যাতন করা যাবে না’। কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যক্তিকে (সে যত বড় আসামিই হোক না কেন) নির্যাতন করা যাবে না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এ দেশে নির্যাতন করা হয় এবং এটা আমরা সবাই জানি। বড় মামলায় পুলিশ রিমান্ডের আবেদন না করলে আমরা মর্মাহত হই।

সংবিধানে কিছু অধিকার আছে শর্ত সাপেক্ষে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের বৃহত্তর প্রয়োজনে কিছু অধিকারকে আইন দ্বারা সীমিত বা নিয়ন্ত্রিত করা যাবে। যেমন সংবিধানের ৪৩(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’ অর্থাৎ আমি যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে চিঠি বা ই–মেইল লিখি বা টেলিফোনে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলি, সেটা কেউ ফাঁস করতে পারবে না। অর্থাৎ আড়ি পাতা যাবে না।

তবে আগেই বলেছি, এই অধিকারটা নিঃশর্ত বা অকাট্য নয়। কেননা ৪৩ অনুচ্ছেদেই বলা আছে যে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’ যোগাযোগের গোপনীয়তার অধিকার সীমিত করা যাবে। যেমন জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোনো আইনে, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজ বা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কিংবা প্রতিকারে নির্দিষ্ট সন্দেহভাজন ব্যক্তির কথোপকথন সাময়িক প্রয়োজনে রেকর্ড করার বিধান সংশ্লিষ্ট আইনে থাকতে পারে। আমাদের জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোনো আইনে এ রকম বিধান আছে বলে চোখে পড়েনি। যেমন ২০১৮ সালের সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আড়ি পাতাসংক্রান্ত কোনো বিধান তালাশ করে পাইনি।

একটি আইনে আড়ি পাতাসংক্রান্ত একটি ধারা খুঁজে পেয়েছি। সেটি হলো বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১। এই আইনের ৯৭ক ধারায় আড়ি পাতার বিষয়ে বলা আছে, শুধু দুটি কারণে, অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে’ কেবল ‘গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তা’ দুই ব্যক্তির কথোপকথন সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে আড়ি পাততে পারবেন।

তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেকোনো সদস্য, যেকোনো নাগরিকের কথাবার্তায় আড়ি পাততে পারবেন? এই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট নয়। কেননা ৯৭ক ধারার পরের উপধারায় বলা হয়েছে, আড়ি পাতার অনুমতি দিতে পারবেন শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী।

আমার-আপনার কথোপকথনে আড়ি পাতলে সেটা হবে সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তবে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আড়ি পাতা অতি জরুরি বা প্রয়োজনীয় হতে পারে। যেহেতু এখানে নাগরিকের সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িত, সেহেতু শুধু খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে আড়ি পাতার ফাইলে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ডিসি, এসপি থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবসহ অন্য কোনো কর্মকর্তা আড়ি পাততে পারবেন না বা আড়ি পাতার অনুমতি দিতে পারবেন না এবং বেআইনিভাবে আড়ি পেতে রেকর্ড করা কথোপকথন কোনো মামলায় সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হতে পারবে না।

কিছু কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে মাঝেমধ্যে আড়ি পেতে রেকর্ড করা কথাবার্তা শোনানো হয়। খেয়াল রাখতে হবে, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১–এর ৭১ ধারায় বিধান করা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি অপর দুই জন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়ি পাতেন, তাহা হইলে প্রথমোক্ত ব্যক্তির এই কাজ হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পঁাচ) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে] বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’

কয়েক সপ্তাহ আগে অলি বনাম রাষ্ট্র (ডেথ রেফারেন্স কেস নাম্বার ৬১/২০১১) মামলায় তিন মাননীয় বিচারপতির (বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ. এস. এম. আব্দুল মোবিন) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ আড়ি পাতা, কললিস্ট এবং এই সব আধুনিক প্রযুক্তির সাক্ষ্যমূল্যসংক্রান্ত একটি বিস্তারিত জ্ঞানগর্ভ রায় দিয়েছেন। রায়ের মোদ্দা কথা হলো, আইন না পাল্টিয়ে বিচারে এসব রেকর্ডিং সাক্ষ্য বা প্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হতে পারবে না।

তবে আমার শঙ্কা হলো, তড়িঘড়ি আইন করতে গিয়ে সংবিধানকে না আবার ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। ১৯৭২–এর সংবিধানে অনেক ভালো ভালো বিধান ছিল। এখন সেগুলো উপেক্ষা করা বা পাশ কাটিয়ে যেতে আমরা ভীষণ ব্যস্ত। এই সব ভালো লক্ষণ নয়।

ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনের সাবেক শিক্ষক