Thank you for trying Sticky AMP!!

ই–কমার্স নিয়ে যত বিপত্তি

ই-কমার্স, অর্থাৎ ইলেকট্রনিক কমার্স বা ব্যবসা নিয়ে আজকাল দেশের ছোট থেকে শুরু করে প্রধান সব কাগজ ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি ও বলাবলি হচ্ছে। তাতে খবরের কাগজ যাঁরা পড়েন না, তাঁদেরও এ বিষয়ে না জেনে উপায় নেই মনে হয়। করোনার তীব্রতার মধ্যে যখন খুদে বার্তা কিংবা ই-মেইলের মাধ্যমে ফেসবুক দেখে ছোট ছোট পণ্য কেনার জন্য অদৃশ্য কোনো বিক্রেতার কাছে অনুরোধ জানানো হতো এবং অল্প সময় পর তা নিয়ে বাইসাইকেলে চেপে সাধারণত উঠতি বয়সের একটি ছেলে এসে উপস্থিত হতো, তখন তাকে দামের সঙ্গে সামান্য কিছু বকশিশও দিতেন অনেকে। আর ই-বাণিজ্য হাঁটিহাঁটি পা পা করে আমাদের এখানেও যে শুরু হচ্ছে, তার জন্য বেশ খুশি খুশি লাগত।

কিন্তু সাগরজলে ভেসে আসা সেই বোতল ভেঙে যে দৈত্য বেরিয়ে এল, সে তো আমাদের তিনটি ইচ্ছা পূরণ করছেই না, বরং কেড়ে নিয়ে গেছে আমাদের সবকিছু। গণমানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে তাঁদের কেউ কেউ লাপাত্তা আর জনা কয়েক হাজতবাস করছেন। তাঁদের মধ্যে এক রাঘববোয়াল ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, টাকা কীভাবে ফেরত দেওয়া যাবে, তা তিনি জানেন না। সব রাঘববোয়ালের অবস্থা কমবেশি একই। কিন্তু কখনো নিজের এবং কখনো ধারদেনার টাকা এমনভাবে যাঁরা এই সব দৈত্যের তলাবিহীন পেটে ঢুকিয়েছেন, তাঁদের অবস্থা কী হবে, তা বোধ হয় এখন কেউই বলতে পারেন না।  

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নানান ধাঁচের ই-বাণিজ্যের প্রতারণার শিকার যে হাজার হাজার লোক, তাঁদের এই দুরবস্থার জন্য প্রথমত এবং প্রধানত তাঁরা নিজেরাই দায়ী। লোভ মানুষের স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তি। কিন্তু এর প্ররোচনায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কেউ যদি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকেন, তাহলে পথে হোঁচট খেয়ে তাঁর হাত-পা ভাঙলে, কিংবা তার চেয়েও বড় কোনো বিপদ ঘটলে রাস্তার দোষ দেওয়ার আগে নিজের সীমাহীন লোভকে দোষ দেওয়া উচিত। অবাস্তব যেসব সম্ভাব্য প্রাপ্তির মুলা ঝোলানো হয়েছিল প্রতারিত এই সব মানুষের সামনে, তাঁদের কেউ কি একবারও ভেবে দেখেননি ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, নিজের গাঁটের পয়সা উজাড় করে লোকসান দিয়ে, সারা দেশের মানুষকে ত্রাণ দিতে নামেনি তারা! ওই লোকেরা তখন এতটাই লোভাতুর হয়ে পড়েছিলেন যে সেসব কোনো চিন্তা তাঁদের মাথার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি। ভূত-ভবিষ্যৎ না ভাবার সেই কঠিন মূল্য তাঁরা এখন দিচ্ছেন। তাঁদের এই মূল্য দেওয়া কখনো ফুরোবে কি না, সন্দেহ।

হাজার হাজার কোটি টাকা তো প্রায় রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। সুতরাং, অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে, জোর প্রচেষ্টা চালালে হাতিয়ে নেওয়া এই টাকার সবটা না হলেও, প্রায় সব আদায় করা সম্ভব বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন। সরকার এদিকে নজর দেবে বলে আশা করি।

তবে এ-ও বলি, দেশের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করা এবং ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স দিয়ে অনুমতি দেওয়ার জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষও তো আছে। তাদের দায়িত্ব তো শুধু অনুমতি দিলেই শেষ হয়ে যায় না, লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরা আইনানুগভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন কি না, বেআইনিভাবে মানুষকে কিংবা রাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছেন কি না কিংবা অন্য কোনোরূপ বেআইনি পথে চলছেন কি না, তা দেখা রাষ্ট্রের অবশ্যকর্তব্য এবং সে জন্য বেশ কটি আইনও রয়েছে। এ কথা ঠিক যে ই-কমার্স নতুন ধরনের একটি ব্যবসা, এটি সার্বিকভাবে পরিচালনার জন্য কোনো কর্মপদ্ধতি এখনো নাকি তৈরি করা হয়নি। কিন্তু নাগরিকদের কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, এই কর্মপদ্ধতি তৈরি করতে এত দেরি কেন হলো, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহলে অস্বস্তিতে পড়বে।

জানা গেল, ২০১৯-এ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে একটি এস্ক্রো (escrow) হিসাব খুলে গ্রাহকের কাছ থেকে আগে টাকা নিয়ে ওই হিসাবে তা রেখে, পণ্য গ্রাহককে দেওয়ার পরই কেবল ই-কমার্সের বিক্রেতাকে টাকা দেওয়া হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে এটি এখনো নাকি বাস্তবায়িত হয়নি। হলে এত দিনে এত মানুষের হাজারে হাজারে কোটি টাকা হয়তো দৈত্যদের পেটে ঢুকে যেতে পারত না। এস্ক্রো হিসাব মূলত একটি ব্যাংক হিসাবের মতোই। তবে এটি সাধারণত ব্যবহৃত হয় স্থানীয় সরকারের কর, বন্ধকি ইত্যাদির ক্ষেত্রে। কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা যেত।

খবরের কাগজের তালিকা অনুযায়ী, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, নিরাপদ ডটকম ও এসপিসি ওয়ার্ল্ডনামীয় প্রতিষ্ঠান কটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো মামলাই হয়নি। মামলার ফলাফল কী হবে এবং কত দিনেই-বা তা হবে, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নেতিবাচক একটা ধারণা সব সময়ই বিরাজ করে। এই দিক মনে রেখে সংশ্লিষ্ট সবাই যদি কাজ করে, তাহলে সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে মানুষের মনে ইতিবাচক একটি ধারণা তৈরি হতে পারে।

এই হাজার হাজার কোটি টাকা তো প্রায় রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। সুতরাং, অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে, জোর প্রচেষ্টা চালালে হাতিয়ে নেওয়া এই টাকার সবটা না হলেও, প্রায় সব আদায় করা সম্ভব বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন। সরকার এদিকে নজর দেবে বলে আশা করি।

এ ছাড়া এ-জাতীয় ফাটকাবাজি ব্যবসা যত দূর সম্ভব নিরুৎসাহিত করা উচিত। এ-সংক্রান্ত আইনগুলো পরিবর্তন করে প্রতারকদের কঠিন শাস্তির বিধান রাখা উচিত বলে আমরা মনে করি। তবে একই সঙ্গে নিয়মমাফিক, সৎ ই-কমার্স যাতে উৎসাহিত হয় এবং আকার ও প্রকারে বাড়ে, সে বিষয়ে উৎসাহব্যঞ্জক আইনি কাঠামো তৈরি করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও যাতে এগিয়ে যেতে পারে, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

আলী আহমদ বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য