Thank you for trying Sticky AMP!!

উন্নয়ন: লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও ধনী ও দরিদ্রের আয়বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম মঙ্গলবার দ্বিতীয় ‘কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইকুয়ালিটি-সিআরআই’ যে সূচক প্রকাশ করেছে, তাতে এটা বলা হয়েছে। আয়বৈষম্য হ্রাসের সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম। এই বৈষম্য হ্রাস করতে না পারলে বাংলাদেশের পক্ষে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জন করা কঠিন হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা তো বেশ জোরেশোরেই ঘুরছে। দারিদ্র্য কমছে। বড় বড় উন্নয়নকাজ হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন বড় প্রকল্প গ্রহণের খবর সংবাদপত্রে দেখি। মানুষের গড় আয় বেড়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। নাগরিকদের গড় আয়ুও বেড়েছে। যানজটের ছবি দেখলে বোঝা যায়, বাংলাদেশের নাগরিকেরা বেশি হারে নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করেন। রাজধানী ঢাকায় ঝাঁ–চকচকে বহুতল ভবনগুলো জানান দিচ্ছে, দেশে অর্থনীতির অবস্থা আর আগের মতো নেই।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সফলতার উদাহরণ। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই স্বল্প–মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার শর্তগুলোও পূরণ করেছে। একই গতিতে উন্নয়ন ধরে রাখতে পারলে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাবে। এসব বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন।

প্রশ্ন হচ্ছে, ফুলে ওঠা এই উন্নয়নের সুফল কি সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে? দেশে-বিদেশি বিভিন্ন হিসাব বলছে, না। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতি যেমন হয়েছে, তেমনি বৈষম্য সমাজের প্রতিটি স্তরেই বেড়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আর্থিক বৈষম্য এখন বিরাজ করছে। এই বৈষম্য বৃদ্ধির প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে সরকারের তরফ থেকে দ্বিমত থাকতে পারে। সব আমলেই ক্ষমতাসীনেরা সরকারি ডেটা ব্যবহারের জন্য বলে থাকেন। সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, বেসরকারি ডেটায় ভ্রান্তি ও ভুল রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ডেটার ওপর নির্ভর করতে পারি। কিন্তু বিবিএসের ডেটা বলছে, বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে। বিবিএসের সর্বশেষ আয় ও ব্যয়ের খানা জরিপ এ রকমই আভাস দেয়।

এই উন্নয়নের সুফল যাচ্ছে কোথায়? কারা এর সুবিধা ভোগ করছে? বিবিএসের আয় ও ব্যয়ের খানা জরিপ-২০১৬ (এইচআইইএস-২০১৬) অনুসারে উন্নয়নের সুফল অভিজাত পুঁজিপতিদের পকেটে চলে যাচ্ছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এ উন্নয়ন পৌঁছাতে পারছে না। এইচআইইএস-২০১৬ ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দেশে এক নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটছে। ধনিক শ্রেণি আরও ধনী হচ্ছে। সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে অধিক হারে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এই ধনিক শ্রেণির দূরত্ব ক্রমে বাড়ছেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে এই পার্থক্য খুবই প্রকট।

বিবিএসের হিসাব অনুসারে দারিদ্র্য কমেছে ২০১০ সালে তুলনায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চরম দারিদ্র্যের হারও কমেছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু একই হিসাব বলছে, ২০১০ সালের তুলনায় মোট দারিদ্র্য বিমোচনের হার না বেড়ে বরং হ্রাস পেয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ। ওই সময় দারিদ্র্য বিমোচনের হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। জনসংখ্যার সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশের আয়ের ভাগ ২০১০ সালের শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশে। বিপরীতে, সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয়ের ভাগ ছিল ২০১০ সালে ২৪ দশমিক ৬১, যা এখন দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে। শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তির আয়ের ভাগ ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশে। অন্যদিকে, সবচেয়ে গরিবের আয়ের ভাগ ২ থেকে অর্ধেক কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয়ের ভাগই হয় কমেছে, বা এক জায়গাতেই থমকে আছে। এইচআইইএস-২০১৬–এর অন্যান্য ডেটা বিশ্লেষণ করলে এ রকম অনেক সূচকই পাওয়া যাবে, যাতে প্রমাণিত হবে বৈষম্যের বিষয়টি।

এখন বলে রাখা দরকার, আমি অর্থনীতির শিক্ষার্থী না। তবে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসাবে নীতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অসততা এই বৈষম্যের মূল কারণ। রাজনৈতিক নেতারাই দুর্নীতির সুযোগ করে দিচ্ছেন। অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি না থাকার কারণে কোনো জবাবদিহি নেই। এ কারণে এক পক্ষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগসাজশ করে আয় করছে। এখানে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী সবাই আছে। এটা শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয়। গোটা সমাজব্যবস্থাই দুর্নীতির চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে যার যা করার কথা, সে তা করছে না।

এই উন্নয়নযজ্ঞে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। এই উন্নয়ন নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা নিয়ে মনে হয় সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে বেকারের সংখ্যা যে অনেক তা কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক অংশগ্রহণ থেকেই ধারণা করা যায়। একদিকে যেমন নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়নি, অন্যদিকে সরকারি চাকরির সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবার নতুন করে সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে চাকরিজীবীদের মধ্যেও আয়–পার্থক্যের সৃষ্টি হচ্ছে।

মূলত, বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে অবকাঠামোনির্ভর ভোটার তুষ্টিমূলক উন্নয়ন। তাই বড় বড় নির্মাণকাজ হচ্ছে। ঘটা করে উদ্বোধন করা হয়। এটা নির্মাণকাজের দলীয় ঠিকাদারদের জন্য সুখবর হতে পারে। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ে না। স্বাস্থ্য খাতে অধিক বরাদ্দ করা হয় না। মানসম্পন্ন শিক্ষার কোনো উদ্যোগ নেই। নতুন নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্পন্ন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ে না। জনবল নিয়োগ করা হয় অধিক হারে। যার কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা অর্জন করাও সম্ভব না।

প্রবীণ, বয়স্করা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। শুধু প্রবীণ বা বয়স্কই কেন? দেশের সব মানুষই তো সঠিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। বিত্তবানরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে। আর যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কোথায় যাবেন? সরকারি হাসপাতালে? রাষ্ট্রের পরিচালকদের যেখানে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আস্থা নেই, সেখানে আমজনতার আস্থা থাকে কী করে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসা সহায়তার জন্য যে পরিমাণ আবেদন নজরে পড়ে, তাতে সহজেই বোঝা যায়, দেশের মানুষ ভালো নেই। সর্বোচ্চ সনদধারী চাকরিজীবীকে যখন প্রাণঘাতী রোগের সহায়তার জন্য সাহায্যের আবেদন করতে হয়, তখনই বোঝা যায়, রাষ্ট্র ওই নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না। বরং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ধনিক শ্রেণি স্বার্থ নিশ্চিত করছে।

এই চলমান অবকাঠামোনির্ভর উন্নয়ন বাংলাদেশে অধিকাংশ নাগরিকের জন্য কোনো সুখবর বয়ে নিয়ে আসছে না। অবকাঠামোর উন্নয়নের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা খাতেরও উন্নতি ঘটাতে হবে। উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সমান তালে বাড়তে হবে, জনসম্পদকে শ্রম রপ্তানির জায়গা থেকে দক্ষতা দিয়ে আয়ের যোগ্য করতে হবে। এর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক জবাবদিহি ও জনবান্ধব রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো তৈরি ও এগিয়ে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে উন্নয়নের সুফল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষের বৃত্তেই থাকবে। বাদবাকি জনগোষ্ঠীর কী হবে? এদের ঘরে কি কখনো উন্নয়নের সুফল পৌঁছাবে না?

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন