Thank you for trying Sticky AMP!!

এইচএসসিতে ‘অটো পাস’ ভালো সমাধান নয়

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সাত মাস দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় সম্প্রতি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এ বছর না নিয়ে সব ছাত্রছাত্রীকে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার গ্রেডের ভিত্তিতে ‘অটো পাস’ দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্তটি অবিমৃশ্যকারী ও অদূরদর্শী। তাই সময় থাকতেই এই ‘তুঘলকি সিদ্ধান্ত’ বাতিল করে পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এটি ১৩-১৪ লাখ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে একজন শিক্ষকের অনুরোধ।

ছাত্রজীবনে রাজনৈতিক কারণে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা কাটছাঁট ও সেশন-বিলম্বের শিকার হয়েছি। এতে আমার নিজের ক্যারিয়ারে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল, সেসব বর্ণনা করলে পাঠকেরা ব্যাপারটির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবেন। যখন আমরা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তখন সেশন নিয়ে প্রথমবার স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহির ‘তুঘলকি সিদ্ধান্তের’ শিকার হই। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৬১ সালের জুন পর্যন্ত ১৮ মাস আমাদের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল শরিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জানুয়ারি-ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাই-জুন সেশন পরিবর্তনের কারণে। কিন্তু ১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের মত আবার পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ায় জানুয়ারি-ডিসেম্বর সেশনে ফেরত আসার জন্য আমাদের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল মাত্র নয় মাস করে। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে আমরা অষ্টম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে আবার আগের নিয়মে ফেরত আসি। মাঝখান থেকে একটি ব্যাচের ছাত্রছাত্রী যারা ডিগ্রির তৃতীয় বর্ষে ছিল, তারা বিনা পরীক্ষায় ‘অটো পাস’ পেয়ে বিএ, বিএসসি ও বিকম ডিগ্রি অর্জন করে প্রথমে খুশিতে ডগমগ হলেও পরবর্তী ক্যারিয়ারের পদে পদে তাদের ওই অটো পাসের জন্য হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল।

এরপর আমাদের দ্বিতীয়বার সেশন-বিলম্বের সম্মুখীন হতে হয়েছিল ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের কারণে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অর্থনীতি অনার্স পরীক্ষা প্রায় ছয় মাস পিছিয়ে গিয়েছিল ১৯৬৮ সালের আগস্ট মাসে এনএসএফের মাস্তান ‘পাঁচপাত্তুর’ হত্যার জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে খুলে দেওয়ামাত্র গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায়। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের যে অনার্স পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেটা শুরু হলো ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে। অনার্সের লিখিত আট পেপারের মধ্যে ছয় পেপারের পরীক্ষা হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে স্বাধীনতাসংগ্রামের সূচনা ঘটে। অতএব ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বাকি দুই পেপারের লিখিত পরীক্ষা ও পরীক্ষা না নিয়ে ১৯৭২ সালে ওই ছয় পেপারের নম্বরের ভিত্তিতে অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হয় আমাদের, ফার্স্ট ক্লাস মিস করেছিলাম আমি। যাক, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ায় ওই ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যেখানে আমাদের মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরোনোর কথা, ওই রেজাল্ট বেরিয়েছিল ১৯৭৩ সালের জুলাইয়ে।

এখন বুঝতে পারি, দেড় বছর আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও স্বাধীন বাংলাদেশে মাস্টার্স শেষ পর্বের ক্লাস ও পরীক্ষা ঠিকমতো সম্পন্ন হওয়ায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার ক্যারিয়ার সফল হয়েছিল অনার্স পরীক্ষার অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও।

নিজের এ অভিজ্ঞতাটুকু বর্ণনা করছি পরীক্ষার গুরুত্বটা তুলে ধরার জন্য। এইচএসসি ‘অটো পাস’ যারা পেতে যাচ্ছে, তারা এখন খুশি হলেও পরবর্তী জীবনে পদে পদে তাদেরও হেনস্তার শিকার হতে হবে। এখন এইচএসসি পরীক্ষার যে গ্রেডিং সিস্টেম, সেটা আংশিক বিবেচিত হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির যোগ্যতা নির্ধারণে, বাকিটা লিখিত। অটো পাসের গ্রেডকে কি আদৌ এভাবে বিবেচনা করা হবে? বুয়েট, অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজে ভর্তি, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি —প্রতিটি ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্সে’ ভর্তিপ্রক্রিয়াকে কি এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে নানা জটিলতায় ফেলা হচ্ছে না?

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সাত মাস ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত তিন বছর থেকে সাড়ে তিন বছরের সেশন-জ্যামের অসহায় শিকার হয়েছিল। গত এক দশকে ওই সেশন-জ্যাম প্রায় দূর করা গেছে। এবারও যদি আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এইচএসসি পরীক্ষার রুটিন ঘোষণা করে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পরীক্ষা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে রেজাল্ট দেওয়া সম্ভব।

ক্যারিয়ার-পছন্দের দৃষ্টিকোণ থেকে এ দেশের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা এইচএসসি পরীক্ষা। অতএব পিএসসি বা জেএসসি পরীক্ষার সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষাকে একই দৃষ্টিতে দেখা মারাত্মক ভুল। এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের উচ্চতর শিক্ষার পছন্দ নির্ধারণের বিষয়টি যুক্ত। এইচএসসি পরীক্ষায় ‘অটো পাস’ ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ জীবনকে মারাত্মক প্রতিবন্ধিতার মুখোমুখি করে দেবে। বিশ্বের অনেক দেশে করোনাভাইরাস মহামারির বিপদ সত্ত্বেও স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলেও নভেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য মনে করছি।

পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যথাযোগ্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য প্রতি পরীক্ষাকক্ষে অন্যান্য বছরের অর্ধেক পরীক্ষার্থীর আসনের ব্যবস্থা করা যায়। পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত কলেজগুলোর সঙ্গে আশপাশের হাইস্কুলগুলোতে এইচএসসি পরীক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রবেশকারী ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের হাত ধোয়ার কড়াকড়ি কঠোরভাবে পালন করা যায়। কেন্দ্রের আশপাশে অবস্থিত কমিউনিটি সেন্টারগুলো ভাড়া করে পরীক্ষাকেন্দ্রের অতিরিক্ত আসনের সংকুলান করা যায়।

অতিরিক্ত পরিদর্শক হিসেবে এলাকার সব কলেজের শিক্ষকদের ইনভিজিলেশান-ডিউটি বণ্টন করে দেওয়া যায়। পরীক্ষার খাতা সংগ্রহ করার পর স্যানিটাইজার স্প্রে করে ওগুলোকে ভাইরাসমুক্ত করা যায়। এমনকি পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাস্কের সঙ্গে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে হ্যান্ড গ্লাভসও পরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। মূল কথা হলো পরীক্ষা নিতেই হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এখনো ‘ড্যামেজ-কন্ট্রোল’-এর সেরা উপায় পরীক্ষা গ্রহণ। ‘অটো পাস’-এ ক্ষেত্রে কোনো ভালো সমাধান হতে পারে না।

ড. মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক