Thank you for trying Sticky AMP!!

এইটি ইয়ারস ইয়াংয়ের চলে যাওয়া

অধ্যাপক আ ফ ম খোদাদাদ খান

যশোর, ঝিনাইদহ হয়ে খুলনার গণিত উৎসব। বিকেলে উৎসব শেষ করে গণিতের গাড়ি রওনা হয়েছে ঢাকার পথে। রাতের মধ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্য, কারণ শীতটাও পড়ছে জাঁকালো। কিন্তু বিধিবাম। গোপালগঞ্জ জেলার কোনো এক জায়গায় আমাদের মাইক্রোবাসের চাকা সশব্দে ফেটে গেল। পথ পরিবর্তন করে আমরা প্রথমে গেলাম ফরিদপুর শহরে। সেখানে নতুন চাকা কিনে খাওয়াদাওয়া করে রাত ১২টার দিকে আমরা পার হলাম পদ্মা নদী। পাটুরিয়া থেকে গাড়ি যখন মূল রাস্তায় ঢুকল, তখন রাত আরও গভীর হয়েছে। ঘন কুয়াশায় সামনে কিছু দেখা যায় না। ড্রাইভারের সহযোগী হয়েছি আমরা তিনজন। একটু একটু করে গাড়ি আগায়। গাড়ির ভেতরে আমাদের ‘এইটি ইয়ারস ইয়াং’ দুই শিক্ষকের দিকে তাকালাম, ‘আমরা কি কোথাও থেমে থাকব?’। স্যাররা অভয় দিলেন, না এগিয়ে যাও। ঘন কুয়াশা কেটে রাত তিনটার দিকে আমরা খোদাদাদ খান স্যার আর লুৎফুজ্জামান স্যারকে তঁাদের বাসায় নামিয়ে দিই। শুধু সেবার নন, আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের সময়কালে এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটে চলার সময়ে খোদাদাদ খান স্যার প্রায়ই আমাদের সঙ্গী হতেন। এটা যে শুধু গণিতের টানে তা কিন্তু নয়। বরং তিনি ভাবতেন সারা দেশের ছেলেমেয়েদের কাছে এভাবে যদি গণিতের সৌন্দর্য তুলে ধরা যায়।
গণিত অলিম্পিয়াডের তৃতীয় বা চতুর্থ আসর থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন আমাদের প্রণম্য গণিতবিদ অধ্যাপক আ ফ ম খোদাদাদ খান। সেই থেকে গণিত উৎসবের সঙ্গে স্যারের সম্পর্কটা আত্মারই সম্পর্ক। প্রতিবছর সারা দেশের উৎসবের সময়সূচি করার সময় আমি ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ বা বায়েজিদ ভুইঞা স্যারের কাছে জানতে চাইতাম স্যার কোথায় কোথায় যাবেন। প্রথম প্রথম আমরা স্যারের প্রাণচাঞ্চল্য দেখে অবাক হতাম। পরে আমরা বুেঝছি খোদাদাদ স্যার আমাদের মতো তরুণ-বৃদ্ধদের চেয়েও তরুণ।
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সন্তান বলেই হয়তো স্যার এমনটা ডাকাবুকা ছিলেন। সেখানেই স্যারের জন্ম, ১৯৩৬ সালের ১ নভেম্বর। স্কুল–কলেজের পড়ালেখা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাবল অনার্স-গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানে, ১৯৫৬ সালে। তবে উচ্চতর পড়াশোনায় বেছে নেন ফলিত গণিত। ১৯৫৭ সালে ওই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মাস্টার্স। এরপর চলে যান চৌমুহনী কলেজে, শিক্ষক হিসেবে। সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করে ঢাকায় ফেরেন, তখনকার জগন্নাথ কলেজে (এখন বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৬৮ সালে চলে আসেন নিজের বিভাগে।
১৯৬৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত গণিত বিভাগে প্রভাষক, অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। ওই সময় যঁারা স্যারের ছাত্রছাত্রী ছিলেন তঁাদের কাছ থেকে জানা যায় স্যার কতটা সৃজনশীল ছিলেন। গেল শতকের সত্তর দশকের শেষের দিক থেকে স্যার যুক্ত হয়ে যান পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত গণিতের পাঠ্যপুস্তক রচনা, সম্পাদনা ছাড়াও গণিতের পাঠ্যসূচি প্রণয়নেও স্যারের ভূমিকা অপরিসীম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হওয়ার পর সেখানকার কারিকুলাম ঠিক করার কাজেও স্যার যুক্ত ছিলেন।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য স্যারের লেখা ‘স্থিতিবিদ্যা’ বইটি আমাদের পাঠ্য ছিল। তবে কেবল গণিতের বই নয়, নিজের ছাত্র নির্মল কান্তি মিত্রের সঙ্গে যৌথভাবে লিখেছেন ‘স্কুল গণিতের ভিত্তি’ ও ‘স্কুল জ্যামিতির ভিত্তি’ নামে দুটি বিশেষ গ্রন্থও। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ফাঁকে ১৯৭৫ সালে আমেরিকার অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যার আবারও গণিতে মাস্টার্স করে আসেন।
শুধু পড়ানো ও বই রচনায় খোদাদাদ খান স্যার নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। গণিতের মান উন্নয়নে, প্রসারে এবং জনপ্রিয়করণে কাজ করতে কখনো পিছপা হননি। শুরুতেই বলেছি আমাদের সঙ্গে খোদাদাদ খান স্যার ডাচ্–বাংলা ব্যাংক–প্রথম আলো গণিত উৎসবে এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটে গেছেন মাইক্রোবাসে চড়ে! তত দিনে স্যারের বয়স প্রায় সত্তর ছুঁয়েছে! ২০০৯ সালে সরকারের ‘মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত শিক্ষার মানোন্নয়ন’-এর জন্য একটা কমিটিতে স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম প্রত্যক্ষভাবে ও সরাসরি কাজ করার সুযোগ তৈরি হয় এবং আমি টের পাই স্যারের এই অফুরন্ত জীবনীশক্তির উৎস কী। তখনই জানতে পারি স্যার প্রচুর পড়তেন, পড়ার মধ্যেই থাকতেন। নতুন নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন। সৃজনশীল গণিত চালু করার কমিটিতেও স্যারের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেবার শিখেছি কীভাবে কাউকে না খেপিয়ে ‘ভেটো’ দিতে হয়!
কয়েক বছর ধরে খোদাদাদ খান স্যারের সঙ্গে কাজ করছি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সৃজনশীল মেধা অন্বেষণে। প্রতিবছরই নির্ধারিত দিনে স্যার হাজির হতেন পকেটে করে নিজের তৈরি করা গাণিতিক সমস্যা নিয়ে। এ বছর স্যার অসুস্থ থাকায় আমরা স্যারকে বলেছিলাম স্যার যেন এমনিতে এসে আমাদের দেখে যান। কিন্তু স্যার আগের রাতে তৈরি করা কয়েকটি নতুন সমস্যা নিয়ে হাজির হন।
পাবলো পিকাসো তাঁর আশিতম জন্মদিনে ‘হাউ ওল্ড আর ইউ’ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন ‘আই অ্যাম নট ওল্ড, আই অ্যাম এইটি ইয়ারস ইয়াং’। আমাদের গণিতের পাবলো পিকাসো এইটি ইয়ারস ইয়াং ব্যাপারটা কেমন, সেটিই আমাদের সামনে রেখে গেলেন।
কাল রাতে খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়েছে আমাকে কেউ আর ফোন করে বলবে না, ‘কী মুনির মিয়া? তোমার ম্যাথ অলিম্পিয়াড টিমের খবর কী। ওরা তো আগেরবারের চেয়ে ভালো করেছে। তোমার টিমের মেম্বারদের আমার আশীর্বাদ পৌঁছে দিয়ো।’
প্রিয় খোদাদাদ খান স্যার। আপনার আশীর্বাদ নিয়ে আমরা আমাদের পথে চলতে থাকব।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।