Thank you for trying Sticky AMP!!

একদা এই দেশে এক নির্বাচন কমিশন ছিল...

পাথরঘাটা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ইভিএমসহ গাড়ি ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা

কে এম নূরুল হুদা কমিশনের ‘সাফল্য’ হলো, আগের নির্বাচন থেকে পরের নির্বাচনটি আরও খারাপ করা। কোনো নির্বাচনে যদি অনিয়ম-দুর্নীতি কিছুটা কম হয়ে থাকে, পরেরটিতে তারা সুদাসলে উশুল করে নেয়।

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শপথ নেওয়ার পর থেকেই কমিশনের পদাধিকারী ব্যক্তিরা শপথ ভাঙতে শুরু করেন। নিজেদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও খামখেয়ালিপনা দেখাতে দেখাতে তাঁরা নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ধ্বংসের কিনারে নিয়ে এসেছেন। এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীরা নিজেদের এতটাই খেলো করে ফেলেছেন যে কেউ মনে করেন না তাঁরা সুষ্ঠু ও অবাধ দূরে থাক, মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবেন।

সাম্প্রতিক কালে নির্বাচন কমিশন পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন মিলিয়ে যেসব নির্বাচন করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনের প্রচারকালে দুজন ও ভোট গ্রহণের দিন আরেকজন প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে আওয়াজ তোলা হয়েছিল, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যা যা প্রয়োজন, তা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুরো শহর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিয়েছে। তাহলে সেখানে কীভাবে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল? নির্বাচন কমিশন কাদের নিরাপত্তা দিল?

সংবিধানে আছে, নির্বাচনের সময় ইসি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার যেকোনো সদস্যকে তার অধীনে নিয়ে আসতে পারে। যে কমিশনের পদাধিকারীরা বরাবর অন্যের অধীনে থাকতে পছন্দ করেন, তাঁরা কীভাবে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন। বরং তাঁরাই নির্বাচনের সময় পুরোপুরি তাঁদের হুকুমবরদার হয়ে যান

তিন সপ্তাহব্যাপী উত্তেজনাপূর্ণ প্রচারণার পর ইসি যে নির্বাচন ‘উপহার’ দিয়েছে, তা নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ এখন হাসি-ঠাট্টা করেন। নগরে কোন প্রার্থীর কেমন ভাবমূর্তি ছিল, তা তাঁদের অজানা নয়। ১৯৯৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ছয়বার নির্বাচন হয়েছে। প্রথম চারটি নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন—মহিউদ্দিন চৌধুরী তিনবার ও মন্‌জুর আলম একবার। এমনকি ২০১৫ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনেও বিএনপির মেয়র প্রার্থী ৩ লাখ ৪ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। আর এবার বিএনপির প্রার্থী পেয়েছেন ৫২ হাজার ভোট। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ভাবতে পারেননি এ রকম ফলাফল হবে। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেছেন। সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের নির্বাচন করার জন্য তো নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন হয় না।

সংবিধান অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা এই বলে শপথ নিয়ে থাকেন, ‘আমি...প্রধান নির্বাচন কমিশনার (বা ক্ষেত্রমতে নির্বাচন কমিশনার) নিযুক্ত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি, আমি আইনানুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত আমার পদের কর্তব্য পালন করিব। ...আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব।’

এখন দেশবাসীই বিচার করুন, তাঁরা সেই কাজটি করেছেন কি না। সংবিধানে আছে, নির্বাচনের সময় ইসি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার যেকোনো সদস্যকে তার অধীনে নিয়ে আসতে পারে। যে কমিশনের পদাধিকারীরা বরাবর অন্যের অধীনে থাকতে পছন্দ করেন, তাঁরা কীভাবে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন। বরং তাঁরাই নির্বাচনের সময় পুরোপুরি তাঁদের হুকুমবরদার হয়ে যান।

আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যায়, জাতীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে যত অন্যায়-অপকর্ম হোক না কেন, কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের জবাব মুখস্থ থাকে। নির্বাচনের হাঙ্গামা হলে তাঁরা বলেন, ‘এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষণ।’ কম ভোট পড়লে বলেন, ‘দেশ যত উন্নত হচ্ছে, ভোট দেওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ তত কমছে।’ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণও তাঁরা দেন। কিন্তু সাম্প্রতিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল সে কথা বলে না। সেখানে ৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানা কারসাজি করেও নির্বাচন কমিশন ২২ দশমিক ৫০ শতাংশের বেশি ভোট দেখাতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনে যাঁরা হর্তাকর্তা হয়ে বসেন, তাঁরা সম্ভবত দেশের মানুষকে বেকুব ভাবেন; না হলে লাগাতার এভাবে অসত্য ভাষণ দিতে পারতেন না। সিইসি একবার বাংলাদেশের নির্বাচন থেকে আমেরিকাকে শিক্ষা নিতে বলেছিলেন। ভাগ্যিস, তারা শিক্ষাটা নেয়নি; নিলে ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকতেন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উত্তাপ গত বুধবার সংসদ ভবন পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিএনপির দুই সাংসদ নির্বাচনের নামে এ ধরনের প্রহসন বন্ধের কথা বলেছেন। জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, যাঁরা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করেছেন, তাঁদের মুখে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শোভা পায় না। মানলাম, ২৫ বছর আগে বিএনপি একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কথা বলার অধিকার হারিয়েছে। কিন্তু দেশের সাড়ে ১০ কোটি ভোটার কী দোষ করেছেন? তাঁরা কেন ভোট দিতে পারবেন না? বিচারপতি খায়রুল হকের যে রায়কে ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার তার আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছিল, সেই রায়েও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক রাখার কথা ছিল। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় সংসদ চাইলে এটি করতে পারে। তবে কোনোভাবে বিচার বিভাগকে সম্পৃক্ত করা যাবে না। ২০০৭-২০০৮ সালে সেই মডেলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে।

কে এম নূরুল হুদা কমিশন দায়িত্ব নিয়েছে ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসাবে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি চার বছর পূরণ হবে। এই চার বছরে নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে যেভাবে তারা ধ্বংস করেছে, অতীতে কোনো কমিশন পারেনি। এমনকি তাদের সদ্য পূর্বসূরি রকিব কমিশনের অধীনেও বেশ কিছু ভালো নির্বাচন হয়েছিল। আর এ টি এম শামসুল হুদা, আবু হেনা ও এম এ সাঈদ কমিশন জাতীয় নির্বাচনকে একটি উন্নত স্তরে নিয়ে গিয়েছিল, যা দেশের ভেতরে ও বহির্বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। আওয়ামী লীগের নালিশ ছিল এম এ আজিজ কমিশন ভোটার তালিকায় ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোট যোগ করে একটি সাজানো নির্বাচনের পাঁয়তারা করেছিল। কিন্তু তারা তো শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি করতে পারেনি, আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। ছবিযুক্ত বিশুদ্ধ ভোটার তালিকা তৈরির পরও কে এম নূরুল হুদা কমিশন কেন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারল না, সেই প্রশ্নের জবাব একদিন না একদিন তাদের দিতে হবে।

বর্তমান কমিশনের আয়ু আছে মাত্র এক বছর। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনই ছিল তাদের বড় পরীক্ষা। চলমান পৌরসভা নির্বাচনের পর ইউপি নির্বাচন হবে। আমরা যদি টাইম মেশিনে সময়কে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির পরে নিয়ে যাই, তখন দেশবাসী পেছনে তাকিয়ে একটি নির্বাচনী রেখাচিত্র দেখতে পাবেন, যেখানে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন (অপর সদস্যরা হলেন মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, বেগম কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার শাহাদত হোসেন চৌধুরী) ভোটারদের নির্বাচনমুখী না করে নির্বাচনবিমুখ করেছে, যারা জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার যেই শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তা ভঙ্গ করেছে। জাতির কাছে দেওয়া ওয়াদা বরখেলাপ করেছে। জনগণের ভোটাধিকারের সুরক্ষা দিতে পারেনি।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে নিশ্চয়ই নূরুল হুদা কমিশনের আমলনামাও লিপিবদ্ধ হবে। সেই আমলনামা পড়ে নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীদের উত্তরসূরিরা আনন্দিত না লজ্জিত হবেন, মাননীয়দের একবার সেই কথাটি ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com