Thank you for trying Sticky AMP!!

একদিন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে

আজকাল দৈনিক সংবাদপত্রের মূল অংশের খবরগুলো বাদ দিয়ে বিশেষ পাতাগুলো পড়ি। বাণিজ্য, খেলা আর বিনোদন পাতায় চোখ বুলিয়ে পত্রিকাটি বন্ধ করে মাথা ঝাড়া দিয়ে এসব থেকে পালাতে পারলেই বাঁচি।  মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী মাসে ৭৯ ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা 

(পত্রিকার হিসাবে ধর্ষণের ঘটনা ৪১, যার ২৯ জনই শিশু), দুই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু, বন্দুকযুদ্ধে হত্যা, খুন, দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, জালিয়াতি, এসবের পেছনে নিজেকেও কোথায় যেন দায়ী মনে হয়।

দিবালোকে রাস্তায় যে কেউ এসে যে কারও শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সেই নারীর চারিত্রিক পবিত্রতা প্রমাণ করতে বলা হয় সে
‘বোরকা পরে ও বেশি বাইরে যায় না’। নইলে যেন-বা তাঁর শরীরে আগুন দেওয়া যুক্তিসংগত হতো। আমাদের এমন চিন্তার কারণেই আমরা অহনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অপরাধে ট্রাক ড্রাইভারের এমন স্পর্ধাকে উপেক্ষা করে মেয়েটাকেই গালমন্দ করেছি। এমন গভীর রাতে কেমন মেয়েরা বাইরে থাকে! নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি। 

সরকারি দপ্তরগুলোতে সামান্য কাজের জন্য গিয়ে দিনের পর দিন হেনস্তা হয়ে অন্য পথ খোঁজার চেষ্টা করে দেশকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এগিয়ে নিয়েছি। বন্দুকযুদ্ধে ‘জঙ্গি’ বা ‘সন্ত্রাসী’ হত্যার ঘটনাকে নিজের জন্য অপ্রয়োজনীয় তথ্য বলে মনে করেছি। আমরা ‘ধর্ষকদের’ বিচার করা দায়িত্ব দিয়েছি রহস্যজনক ‘হারকিউলিসের’ হাতে! মাদকের হাতে তরুণসমাজকে সঁপে দিয়েছি। মাদক ব্যবসায় বারবার সংসদ সদস্যের নাম এলেও
আমরা চুপচাপ তাঁর সাজানো ‘আত্মসমর্পণের ডাক’ নাটকের মহড়া দেখছি। আমরা সম্পদের অসম বণ্টন, শ্রেণিবৈষম্য তৈরিতে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবদান নিয়ে মাথা ঘামাই না। ২৬ লাখ ৭৭ হাজার (বিবিএস, ২০১৭) বেকার জনগোষ্ঠী নিয়ে ভাবি না।

আমি সুবিধাভোগী, ভিতু-প্রকৃতির মানুষ। অন্যের অহেতুক ঝামেলায় নিজেকে জড়াই না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চকচকে ‘অল ওকে’ ইমেজের ভাসমান বুদ্‌বুদে বাস করতে আমি স্বছন্দ বোধ করি। ভালো বিয়ে ও চাকরির লোভে আমি লেখাপড়া করেছি। দেশ উদ্ধার করা আমার কাজ নয়। তাই আমি চোখ-কান বন্ধ করে সব অন্যায়-অবিচার মেনে নিয়েছি। প্রযুক্তি আমার হাতের তালুতে গোটা বিশ্বকে এনে দিয়েছে। সে সারাক্ষণ আমাকে গান, ভ্রমণ, রন্ধনপ্রণালি, সাজ ও কীভাবে চোখের পলকে ওজন কমানো যায়, সেসব তথ্য দিয়ে একটা ‘নিরাপদ’ বলয়ের মধ্যে রাখে। এই বলয়ে আমি আমার মনের একান্ত সব কথা ও নিজের গুণাবলি আমার হাজারখানেক বন্ধু ও বিভিন্ন গ্রুপে আপুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে খুব সক্রিয়। যদিও বাস্তবে আমি খুবই লাজুক। পাশে বসে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না। ১৬ কোটি মানুষের দেশে আমি এভাবেই মুঠোফোনে নিজেকে ‘পাসকোড’ দিয়ে ‘লক’ করে রাখি। আর তারই সুযোগে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দুরভিসন্ধি চলে। বলা হয়, মেয়েদের চার-পাঁচ ক্লাস পাস হলেই হবে, যাতে স্বামীর টাকা গুনতে আর তাকে চিঠি লিখতে পারে। এই ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে এভাবেই অন্ধকার সময় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলে।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৫৮০টি ধর্ষণের ঘটনায় ৮০ শতাংশই শিশু-কিশোর। অনেকে এর জন্য দায়ী করেছেন দুর্বল বিচারব্যবস্থাকে। আমি বলব, এই সমাজ, এই জনগণের দায়ও কম নয়। গণতন্ত্রের বিনাশ, মূল্যবোধের অবক্ষয়, অচল-দলীয় দুর্নীতিবাজ প্রশাসন, বিষাক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, শোষক শ্রেণির বিস্তার, ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড়—এসব এক দিনে হয়নি। এসব আমাদের দুর্বলচিত্তের প্রতিফলন, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে নেওয়ার ফল, শুধু নিজে ভালো থাকতে চাওয়ার প্রতিদান। আমি এই আপস করা শ্রেণির একজন। আমি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ আচরণে বিশ্বাসী।

আমি বর্তমানকে মেনে নিয়েছি। আমি পরিবর্তনের কথা বলি না। আমি আমার মস্তিষ্ক অসাড় করে রাখাকেই করণীয় বলে মনে করি। আমি জানি এভাবে ঘোড়ার মতো চোখ বেঁধে চলতে চলতে একদিন আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে। সেদিন আমার জন্যও কোনো আওয়াজ উঠবে না।

আইরিন খান : লেখক ও গবেষক

khan.ayreen@gmail.com