Thank you for trying Sticky AMP!!

এক পক্ষের সবাই আছে, অন্য পক্ষ শূন্য

আশ্রাফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে ঢুকে পড়েন আরেকজন। ২. ছবি তুলছে, পেছন থেকে কেউ একজন বলার পর ঘুরে তাকান তিনি। ৩. এরপরই কালো কাপড় দিয়ে তৈরি গোপন কক্ষে মাথা নিচু করে ফেলেন তিনি। কামরাঙ্গীরচর চর, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আবদুস সালাম

‘আমি ভোট দিছি, মেশিন অন হইছে। এখন আমি কনফার্ম করব। কিন্তু মার্কা আর নড়ে না। একটি মার্কাই ভাসে, সেটা আর সরেই না। তাদেরকে বললাম, দেখুন, আমি না হয় এই মার্কাতেই দিব। কিন্তু আমার ইচ্ছেমতো দিতে দিন। আমি ক্যানসেলে বহু ক্লিক করেছি। কোনো লাভ হয় নাই। পরে আমারে পুলিশে বাইর করছে।’

ধানমন্ডি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গতকাল বেলা ১১টায় ওই কথাগুলো বলেন ওয়াসার একজন কর্মকর্তা। তিনি ওই কেন্দ্রে সকাল সোয়া ১০টার দিকে ভোট দিতে যান। কিন্তু তাঁর দাবি, যন্ত্র তাঁকে বাধা দিয়েছে।

একই কেন্দ্রে বিচার বিভাগীয় একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক ভোট দিয়ে বের হলেন। বললেন, ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড, যেটা আমারও দেখা, ইভিএমের পাশাপাশি প্রিন্ট কপিও বেরোয়।’ আরেকজন আগন্তুক শুনে বললেন, কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তখন তাঁরা ওই প্রিন্ট কপি দেখান।

এ সময় আরও একজন ইভিএমে বাটন চেপে একটি প্রতীকে স্থির থাকার দাবি করেন। বললেন, ইভিএম ডিসপ্লেতে ভেসে উঠেছে, ‘আপনি নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন’। বুথের পর্দাটা এত পাতলা, চাইলে সেটা সবাই দেখতে পায়। আরেকজনের দাবি, ‘আমি দূর থেকেই শুনলাম, যন্ত্র থেকে শোনা যায়, আপনি অমুক প্রতীকে ভোট দিয়েছেন।’ (সবাই হাসলেন)

এসব শুনে আমি অবাক হওয়ায় তিনিও অবাক। বললেন, ‘আপনারা সাংবাদিক। ইভিএমের ডেমো-টেমো কি কিচ্ছু দ্যাখেন নাই? যান ভেতরে যান। নিজেরাই গিয়ে শোনেন।’ আমরা যাচাই করি, প্রমাণ পাইনি।

আমাদের জটলার উদ্দেশে এগিয়ে এলেন এক আগন্তুক। তিনি তাঁর পরিচিতজনের কাছে জানতে চাইলেন, ভাই, ঠেলাগাড়ি মার্কার প্রার্থী কে? আমি আনারসকেও ভোট দিলাম। (জানি না, হাসির রোল উঠল) আনারসের প্রার্থী সংরক্ষিত মহিলা আসনের শিরীন গাফফার। বুঝলাম, কাউন্সিলর পদে ভোট দুটি তিনি নষ্ট হতে দেননি। অবাধে ভোটদান মানেই যে অর্থপূর্ণ ভোট নয়, এটা তার একটা প্রমাণ।

প্রতিবেদক এই কেন্দ্রে বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। কেন্দ্রে ঢুকতে উদ্যত হতেই কানে এল, গত রাতে একাত্তর টিভিতে দেখলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্দেশে কড়া কড়া কথা বললেন। আরেকটি কণ্ঠে এর প্রতিক্রিয়া ঝরল। ‘গরিবের বউ সকলের ভাবি তো। এখন যদি জিএসপি সুবিধাটা তোলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার ট্যাক্সটা বসায়—।’

নিচতলার বুথে যাই। স্লিপ চাইলে বলি, নেই। নিচের বুথে পোলিং কর্মকর্তার দিকে এগোই। দেখি, বহু লোকের সমাগম। তবে তা ভোটারের
সারি নয়।

বড়সড় একটি ক্লাসরুম। মাঝখানে জটলা। নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে আলাপ চলছে। তাঁরা তরুণ। বুথে প্রবেশের এক বা দুই মিনিটের মধ্যে তাঁরা বেরোলেন।

সেখানে একজন অগ্রজ সাংবাদিক সঙ্গে ছিলেন। তাঁর গলায় ইসির আইডি। গুনলাম। একত্রে একটি দরজা দিয়ে সাতজন বেরোলেন। তাঁদের বয়স পঁচিশের নিচেই হবে।

বুথের কর্মকর্তাকে এনআইডির নম্বর বলি। মেশিনে তা টাইপ হলো। মেশিন বলল, এই কক্ষের ভোটার তালিকায় আপনার নম্বর পাওয়া যায়নি। বুথ নম্বর ৬। এখানে ৩৯৫ ভোট। দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত ২৫টি ভোট পড়েছিল। প্রতি ঘণ্টায় ৬টি ভোট পড়ে। আরেকটি বুথে যাই। সেখানেও না মেলায় একজন পরামর্শ দিলেন, দোতলায় যান।

একটি বুথে ঢুকে দেখি, ভোট গ্রহণ স্থগিত। যন্ত্রের কারিগরি দিক পরীক্ষা করে দেখছেন দুজন সেনাসদস্য।

আরেক বুথে যাই। একজন পোলিং কর্মকর্তা বললেন, স্মার্ট কার্ড সঙ্গে আছে কি? ডিজিটাল কপি দেখাই। আরেকজন অফিসার (সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা) বললেন, এদিকে আসেন। নম্বর থাকলেই চলবে। এই বুথে ভোটার ৪১৮। ভোট পড়েছিল ২৯টি। যথারীতি পরীক্ষা চলল। মেশিন বলল, এখানে আপনার ভোট নেই।

ততক্ষণে নজরে এল, একটি প্রার্থীর পক্ষের ব্যাজধারীদের উপস্থিতি বেশ। ‘শাওন শাওন, ওই দেখ।’ ইসির কার্ড ঝোলানো অগ্রজ সাংবাদিককে দেখে একজন কর্মী আরেকজনকে এমন অস্ফুট উক্তির সঙ্গে দেখালেন। তাঁদের চোখ সন্দিগ্ধ।

আরেকটি বুথে একজন নারী পোলিং কর্মকর্তা প্রথমেই সিরিয়াল নম্বর জানতে চান। না বলতে পারায় সেখানে চলল আঙুলের ছাপ পরীক্ষা। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি, তারপর তর্জনী। না মেলায় এরপর বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী মেশিন পরীক্ষা করে দেখল। মিলল না।

ভাবি, আমার মতো এমন ভোটার থাকতেই পারে, যাঁরা আগে কোনো কারণে আগাম ভোটার নম্বরসংবলিত স্লিপ সংগ্রহ করতে পারেননি। অসচেতনতায় বা অজ্ঞতার কারণে হতে পারে। কিন্তু ডিজিটাল ব্যবস্থা বলতে পারল না, আমি কোথাকার ভোটার। যন্ত্র শুধু দায়িত্ব নিচ্ছে কেউ একটি বুথের ভোটার কি ভোটার নয়, সেটুকুর।

অগ্রজ সাংবাদিক আর আমি চতুর্থ বুথে যাই। এক গৌরবর্ণের তরুণ ভোট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। দরজা থেকে ফিরলেন পোলিং কর্মকর্তাদের সমস্বরের আহ্বানে। তিনি ভোট-বাটন চাপলেও সবুজ যাচাই বাটন চাপেননি। তাই তিনি পুনরায় ঢুকে সেটিতে চাপ দেন। পর্দার ভেতরে থাকা এক কর্মী তাঁকে সহায়তা দেন। তখন ভেসে ওঠে ‘আপনার ভোট সম্পন্ন হয়েছে।’

কোনো প্রাণের পরশ বা উৎসবমুখর পরিবেশের লেশ ছিল না। একপক্ষীয় প্রাধান্যের ছাপ ছিল সর্বত্র দৃশ্যমান।

অগ্রজ ওই বুথে ঢুকে বেরিয়ে যান। ‘ওই লোকটি কে? আপনি কি তাঁর সঙ্গে?’ অসহিষ্ণুতার সুর পেয়ে চকিতে বলি, উনি সাংবাদিক।

 ‘তাঁর তো বুথে ঢোকার কথা নয়।’

বলি, ‘গলায় ইসির কার্ড দেখলাম, মনে হয় পারমিশন আছে।’ ততক্ষণে আরেক কর্মী হাজির। তাঁরা ফিসফাস কথা বলছিলেন। একজন তাঁর স্মার্ট ফোনে আমাকে ভোটের বুথ খুঁজে পেতে সাহায্য করতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু তিনি সফল না হতে নিষ্ক্রান্ত হই।

বেরোতেই দেখি, ২৮ নম্বর কক্ষের সামনে সিঁড়ির প্রবেশপথে বেশ ভিড়। একজন তরুণ, কালো কোট, চশমা ও শ্মশ্রুমণ্ডিত। তিনি দৃশ্যত অন্য পক্ষের জটলায় পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছেন। তাঁকে ঘিরে ডজনখানেক মানুষ। তাঁর বুকের ডান পাশে ঠেলাগাড়ি মার্কার ব্যাজ।

সাফারি পরিহিত এক প্রবীণ নেতা এগিয়ে আসেন। তাঁর উদ্দেশে কালো কোটের তরুণটি হাসিমুখে, সহজ ভঙ্গিতে বলেন, ‘আপনি তো জানেন, আই বিলং টু আওয়ামী লীগ পরিবার। কালই ফিরে যাব কোর্টে।’

পরিষ্কার হলো, তিনি এমন কিছু একটা করেছিলেন, যা বিশেষ একটি দলীয় কর্মীদের পছন্দ হয়নি।

ততক্ষণে ‘ঠেলাগাড়ির’ প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে ওঠা বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি তরুণটিকে বলতে শুনলাম, ‘আমি আমার রেসিডেনসিয়াল আঙ্কেল-আন্টিদের ভোটকেন্দ্রে আনতে চাই। আমি ভালোবাসা কামাতে এসেছি। কাল আমি কোর্টে যাব। মামলা লড়ব।’

পরে রাস্তায় নেমে পোস্টারে তাঁর ছবি দেখি, তিনিই ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী। আইনজীবী ও একজন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’। ঠেলাগাড়ির প্রার্থী হলেন ব্যারিস্টার এস এম মেরাজুল আলম ওরফে আজমান।

ওই ভোটকেন্দ্রের বাইরে সর্বত্র একটি প্রতীকের প্রবল প্রাধান্য। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারও কোনো ধরনের উপস্থিতি, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে–বাইরে বা ধারেকাছেও একদম নজরে এল না।

তবে এক অপরিচিত ভদ্রলোক হঠাৎ এগিয়ে এলেন। মেয়েকে দেখালেন। তিনি সরলমনে বা সুচিন্তিতভাবেই বললেন, ‘আমরা বাপ–বেটি ভোট দিলাম। কোনো সমস্যা দেখিনি। কিন্তু জানি কালকের পত্রিকায় দেখব, সুষ্ঠু ভোট হয়নি, সব ওলটপালট হয়ে গেছে।’

১২টা ৭ মিনিট। ফটকের বাইরে একমাত্র নির্বাচনী টেবিলের সহাস্য কর্মীর সাহায্য নিই। তিনি আমারই মুঠোফোনের মেসেজ অপশনে গিয়ে ‘পিসি’ শব্দের পরে আইডি নম্বর বসিয়ে ১০৫ নম্বরে বার্তা পাঠান। বলেন ৩০ মিনিট পরে জানতে পারবেন কোথায় আপনার ভোট। পরে দেখি, বার্তাটি ‘ফেইলড’ দেখাচ্ছে, সেটি যায়নি।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com