Thank you for trying Sticky AMP!!

এক রাজনীতিকের ভাগ্যের দোলাচল

আ জ ম নাছির উদ্দীন। ছবি: ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত

২০১৩ সালের নভেম্বরে যখন আ জ ম নাছির উদ্দীন আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন, তখন অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। আগের মেয়াদে কমিটির সাধারণ সদস্যের পদও যাঁর ভাগ্যে জোটেনি, তিনি এটা–ওটা নয়, সরাসরি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করলে বিস্মিত হওয়ারই কথা। কিন্তু যাঁরা ধরে নিয়েছিলেন বিস্ময়ের সেখানেই শেষ, তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। এর মাত্র দেড় বছরের মাথায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে অনেকের চোখ কপালে তুলে দিয়েছিলেন তিনি।

এর আগে তিন-তিনবারের নির্বাচিত মেয়র, দলের নগর কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী তত দিনে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, কিছুটা জরাগ্রস্তও। তবু আরও একবার নির্বাচন করার ইচ্ছা হয়তো তাঁর ছিল। মেয়র হিসেবে তাঁর অতীতের সাফল্যের কারণে দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে, এমন ধারণাও করেছিলেন অনেকে। কিন্তু তত দিনে নাছিরের ভাগ্যে লেগে গেছে ‘জাদুর কাঠি’র স্পর্শ। দলের সাধারণ সম্পাদক পদ লাভ, মেয়র পদে মনোনয়ন—একের পর এক সাফল্যের সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছেন তিনি।

চট্টগ্রামের দলীয় রাজনীতিতে মহিউদ্দিন-নাছির দ্বন্দ্ব ও সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে নিয়মিত সংঘাত-সংঘর্ষের কথা সর্বজনবিদিত। দীর্ঘকাল দলের কোনো পদে না থেকেও মহিউদ্দিনের মতো ঝানু রাজনীতিকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ও কর্মী–সমর্থকদের একটি অংশের সমর্থন লাভ নিঃসন্দেহে নাছিরের বিস্ময়কর কৃতিত্ব (!)। এর সঙ্গে মাত্র দেড়-দুই বছরের মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়া, মেয়র পদে মনোনয়ন লাভ ও বিজয় ইত্যাদি দেখে অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন, চট্টগ্রামের রাজনীতিতে মহিউদ্দিন যুগের বোধ হয় অবসান হলো। যাঁরা এ রকম ভেবেছিলেন, তাঁরা ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ এই আপ্তবাক্য মনে রাখেননি। মাত্র পাঁচ বছর পর আজ তাই আবার মনে হচ্ছে, নাছিরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আরও একবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ তিনি কীভাবে সামাল দেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

মেয়র পদে আ জ ম নাছিরের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। করোনার মতো অতিমারি হানা না দিলে এত দিনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নতুন মেয়রের অভিষেক হতো। তা হয়নি। এতে মেয়র হিসেবে নাছিরের দায়িত্ব কিছুটা দীর্ঘায়িত হলো। এখন প্রশ্ন হলো, কেন দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র পদে মনোনয়ন পেলেন না তিনি এবং মেয়র হিসেবে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সাফল্য-ব্যর্থতাই কি দলীয় মনোনয়নের শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

মেয়র হিসেবে মোটা দাগে তাঁর সাফল্যের কথা উল্লেখ করলে প্রথমেই আসবে বিলবোর্ড উচ্ছেদ প্রসঙ্গ। নগরের অজস্র বিলবোর্ড উচ্ছেদ করে তিনি প্রকারান্তরে তাঁর সাহস ও সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বিলবোর্ডের মালিকানা ছিল সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের। নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রামকে মোটামুটি মানের একটি পরিচ্ছন্ন নগরে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও প্রশংসিত হয়েছে। রাস্তাঘাট সংস্কারের কাজে সাফল্য, ব্যর্থতা—দুই–ই আছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি সব কালে সব মেয়র পদপ্রার্থীর নির্বাচনী ইশতেহারে থাকলেও কোনো মেয়রই কখনো সফল হতে পারেননি। বর্তমান মেয়রের মেয়াদকালেও এই প্রকল্পের জন্য সরকার যখন সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) বরাদ্দ দেয়, তখন আসলে এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় যে দায়িত্বটা আসলে কার?

যাহোক, পাঁচ বছর মেয়াদে মেয়র হিসেবে নাছিরের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান পর্যালোচনা করে আর যা-ই হোক, তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে মনোনয়ন না দেওয়ার মতো জোরালো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতার মূল্যায়নের চেয়ে অন্তর্দলীয় কোন্দলই প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আগেই বলেছি, মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল আ জ ম নাছিরের। এই দুজনের তিক্ত সম্পর্কের রেশ চট্টগ্রামের মূল সংগঠন থেকে শুরু করে ছাত্র-যুব সংগঠন পর্যন্ত বিস্তৃত। ঘটনার পরম্পরায় একপর্যায়ে চট্টগ্রামের প্রবীণ রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, সাংসদ এম এ লতিফসহ বেশ কজন রাজনীতিক আ জ ম নাছির উদ্দীনের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলে দলে তাঁর অবস্থান পোক্ত হতে থাকে। দলের শীর্ষ পর্যায়েও তাঁর ইতিবাচক একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়। নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক হওয়া এবং মেয়র পদে মনোনয়ন পাওয়া এই ধারাবাহিকতারই অংশ।

কিন্তু মেয়র হওয়ার পর এই পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারলেন না নাছির। ‘জাতিসংঘ পার্কের’ উন্নয়নকাজ নিয়ে তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে, নগর উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের সঙ্গে এবং বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাংসদ এম এ লতিফের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তাঁকে ধীরে ধীরে কখন দলের মধ্যে নিঃসঙ্গ করে তুলেছে, নিজেও হয়তো বুঝতে পারেননি তিনি। এদিকে ঠিক সেই সময়টাতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী প্রথমে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, এর অব্যবহিত পরে সাংসদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী হলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা সত্যিকার অর্থেই কঠিন হয়ে পড়ল নাছিরের পক্ষে।

এই অবস্থায় হাইকমান্ডের কাছে তাঁর সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কোনো বার্তা পৌঁছানোর আশা করা বাতুলতা। বরং এর উল্টোটাই যে ঘটেছে, তার প্রমাণ খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য। ২০১৭ সালের ১২ মার্চ চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দর এলাকায় একটি সড়কের সংস্কারকাজের দীর্ঘসূত্রতা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন এবং মহিউদ্দিন চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে নগর উন্নয়নে তাঁর দক্ষতা-যোগ্যতার প্রশংসা করেছিলেন। নাছিরের ভাগ্য বোধ হয় সেদিনই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

২৬ জুলাই মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে নাছিরের। শোনা যাচ্ছে, করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে দু–এক দিনের মধ্যে। এখনো নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন তিনি। তবে পাঁচ বছর আগের সেই সুসময় যে নেই, তা সহজেই অনুমেয়। মনে রাখতে হবে, এ রকম বহু দুঃসময়কে অতিক্রম করে নিজের রাজনৈতিক জীবনকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। দীর্ঘকাল নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে কতটা পরিপক্বতা অর্জন করেছেন, এবার তারই পরীক্ষা দিতে হবে নাছিরকে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
bishwabd@yahoo.com