Thank you for trying Sticky AMP!!

এখনো মনটা বিষাদে ভরে যায়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি বিহারের বুদ্ধগয়ায় দারিদ্র্য বিমোচন-বিষয়ক এক গান্ধীবাদী প্রকল্পে কাজ করছিলাম, ১৯৬০-এর দশকের শেষ ভাগে বিহারে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, সেখানকার গ্রামগুলোই তাতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল।
গয়ায় নিচতলার ফ্ল্যাটে থাকার সময় আমি ট্রানজিস্টর রেডিওতে স্টেশন ধরার জন্য ছাদে যেতাম। ওই রেডিও সরাসরি বিদ্যুতে চলত, আবার ব্যাটারিতেও চলত। বিদ্যুৎ যেমন, ব্যাটারিও তেমন গয়া শহরে খুব বিরল ব্যাপার ছিল। এই গয়া শহর ছিল তখন ভারতের সবচেয়ে নোংরা ও গরম শহর, সেখানকার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠত। মার্চের ৭ বা ৮ তারিখে আমি জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের কথা শুনলাম। রেডিওর সংকেত ভালো ছিল না। সে কারণে আমি গয়া শহরের কেন্দ্রে চলে গেলাম, সেখানে কিছু বাঙালি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। কয়েকটি পরিবারও সেখানে থাকত। তারা সব সময় বিবিসি বাংলার খবর শুনত। পূর্ব বাংলা/বাংলাদেশের পরিবারগুলো খুব উদ্বিগ্ন ছিল। আমার বাঙালি বন্ধুরা সেই খবরের ইংরেজি তরজমা করে আমাকে শোনাত, তারা খুব আবেগপ্রবণ ও উত্তেজিত ছিল। তারা খুব পরিষ্কারভাবেই আমাকে বলল, বাংলাদেশ নামক নতুন একটি দেশের জন্ম এই হলো বলে।
২৫ বছরের এক ‘বিদেশি’ হিসেবে আমার বাঙালি বন্ধুদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু শুনলাম, শুনে বিস্মিত হলাম। এর মধ্য দিয়ে একুশের গুরুত্ব সম্পর্কেও জানলাম, আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সঙ্গে কী ব্যবহার করেছে, তা-ও বোঝা হয়ে গেল। কয়েক দিন পর এয়ার মেইলে যুক্তরাজ্য থেকে সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান পত্রিকাটি পেলাম। সেখানে ঢাকার হরতাল, সহিংসতা ও উত্তেজনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। পরবর্তী কয়েকটা দিন আমার পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করলাম। তিনি ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুরকৌশলী, তাঁর জন্ম বিহারের পাটনায় হলেও বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে তাঁর পারিবারিক আত্মীয় আছে; লোকটির বাবা ১৯০০ সালে সেখান থেকে অভিবাসন করেছিলেন।
এর কয়েক মাস পরে আমি বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য পরিচালিত অক্সফামের ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয়ের সুযোগ পাব, তার বিন্দু-বিসর্গ কি তখন জানতাম? পাকিস্তানি সেনা, বেসামরিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় রাজাকাররা সেখানে যে গণহত্যা চালাচ্ছিল, তারা সেটা এড়িয়েই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছিল। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি কি জানতাম, ৭ মার্চের সেই বিস্ময়বিহ্বল করা ভাষণ দিয়েছিলেন যে ব্যক্তি, সেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে আমার দেখা হবে?
স্বাধীনতাযুদ্ধ ও ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর আমি প্রয়োজনীয় ওষুধপূর্ণ অক্সফামের একটি ল্যান্ডরোভার কলকাতা থেকে ঢাকায় আনার পরিকল্পনা করেছিলাম। ২ জানুয়ারি আমি কলকাতা থেকে রওনা দিই।
ঢাকায় পৌঁছানোর পর ইউনিসেফ ও অন্যান্য দাতা সংস্থার কর্মকর্তারা আমাকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার পরামর্শ দেন। আমার সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেন তাজউদ্দীন আহমদ, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তাঁর সঙ্গে আমি কয়েকবার দেখা করেছিলাম। শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা আমি কখনোই ভুলব না। আমি তাঁকে বললাম, অক্সফামের মতো ছোট একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নে কী ভূমিকা পালন করতে পারে, সে বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিন। শেখ মুজিব মুখ থেকে পাইপ বের করে আমার দিকে তাক করে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তরুণ, তুমি এখানে কীভাবে এলে?’ তাঁকে বললাম, কলকাতা থেকে আমি গাড়ি চালিয়ে এখানে এসেছি। তিনি বললে, ‘তাহলে তো এ দেশটা তুমি আমার চেয়ে বেশি দেখেছ। নয় মাসের বেশি আমি কারাগারে ছিলাম, সুতরাং তুমিই আমাকে বলো, আমার দেশের কী প্রয়োজন। তুমি কী দেখেছ?’
আমি শেখ মুজিবকে বললাম, অনেক গ্রাম ভস্মীভূত হয়েছে, অনেক সেতু ও কালভার্ট ধ্বংস হয়েছে, ছোট-বড় অনেক ফেরি নদীতে ডুবে গেছে। আমি বললাম, ভারতে আমি ইতিমধ্যে আড়াই লাখ ডলার মূল্যের সিআই শিটের আদেশ দিয়েছি, এগুলো বড় বড় গৃহ পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের কাজে লাগবে। এগুলো মার্চের শুরুর দিকেই চলে আসবে। আমি আরও বললাম, সেতু নির্মাণ এবং ফেরি মেরামত ও প্রতিস্থাপন—এগুলোই আসলে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহায়তার জন্য সুবিধাজনক। শেখ মুজিব বললেন, ‘না, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য আমাদের জনগণের প্রাণ হচ্ছে ফেরি। দয়া করে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করো। দেখো অক্সফাম এ ব্যাপারে কিছু করতে পারে কি না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
ওখান থেকে আসার আগে শেখ মুজিব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে কেমন লেগেছে? কথা বলার সময় আমি আবেগপ্রবণ হলাম, আমার চোখ সজল হয়ে উঠল। শেখ মুজিব আমার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে বললেন, ‘তরুণ, শক্তি সঞ্চয় করে আগে বাড়ো, আমার সঙ্গে দেখা করা ও বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ।’
তাঁর সঙ্গে দেখা করার পর অক্সফাম তিনটি ট্রাক পরিবহনকারী ফেরি কেনে, আরও অনেক ফেরি-মেরামতে সহায়তা করে। বোধগম্যভাবে বিআইডব্লিউটিএ ফেরিগুলোর নাম স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদদের নাম রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশের প্রাণী ও উদ্ভিদকুল যেভাবে এখানকার কবিতা ও সংগীতের সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে, তা জানার পর আমরা প্রস্তাব করি, ফেরিগুলোর নাম ফুলের নামে রাখা হোক। ফলে এগুলোর নাম হয় কামিনী, কস্তুরি ও করবী। আমার মনে হয়, আজ ৪৪ বছর পরও এসব ফেরি মাওয়ায় যানবাহন ও মানুষ পারাপারে নিয়োজিত রয়েছে।
আজ থেকে ৪৩ বছর আগে সেই সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশ সফরে আমার মনে হয়েছিল, তখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল খাদ্য ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি সাধন, যাতে সেই খাদ্য সব জায়গায় পৌঁছানো যায়। অক্সফামের সহায়তাবিষয়ক পরিচালক কেন বেনেট আমার ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সফরের পর এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘আমি জানি না এটা অতিরঞ্জন হবে কি না, খাদ্য আমদানি ও যোগাযোগব্যবস্থা পুনর্নির্মাণের সমস্যা যত দ্রুত মোকাবিলা করা হবে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সেভাবেই নির্ধারিত হবে।’
এটা বাংলাদেশের বিশাল কৃতিত্ব বলতে হবে। দেশটি শুধু টিকেই যায়নি, সে ব্যাপক উন্নয়নও করেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদনে সে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, যে খাদ্য দেশের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দ্রুততার সঙ্গে পরিবহন করা যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমি অক্সফামের সঙ্গেই ছিলাম, তখন আমার কর্মস্থল ছিল নয়াদিল্লি। সেদিন যখন টিভিতে ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠান দেখছিলাম, তখন শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের হত্যার খবর শুনে সেই অনুষ্ঠান দেখার মাঝপথে ব্যাঘাত ঘটল। প্রচণ্ড আঘাতে আমার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। দুই হাতের মধ্যে মাথা রেখে আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আজ ৪০ বছর পরও ১৫ আগস্ট এলে মনটা বিষাদে ভরে যায়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জুলিয়ান ফ্রান্সিস: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অক্সফামের হয়ে ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয় করেছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মাননা’ খেতাবে ভূষিত।

আরও পড়ুন